পোস্টস

প্রবন্ধ

জনপ্রিয় সাহিত্য মানেই সস্তা সাহিত্য না

২৩ এপ্রিল ২০২৪

আসিফ খন্দকার

'জনপ্রিয় সাহিত্য মানেই সস্তা/মানহিন লেখা'। লেখালেখির সাথে জড়িত কেও কিংবা পাঠক বা সাহিত্যমনা অথচ প্রথম লাইনের এই কথাটি শুনেনি এমন মানুষ পাওয়া যাবে না।সাহিত্যে দুটি ধারার ব্যাপারে লেখক-পাঠক মহলের যত্রতত্র সর্বত্র কথা হয়।মুলধারার সাহিত্য আর জনপ্রিয় ধারার সাহিত্য। ব্যাপারটা কে আমি কিভাবে দেখি এটা প্রথমে বলি।


আমার পাঠকদের বেশীরভাগ যেহেতু ইসলাম ধর্মালম্বী তাই এরকম একটি উদাহরণ দিয়ে বোঝাচ্ছি।
জানাজার নামাজ সম্পর্কে আপনারা আশাকরি জানেন।জানাজা নামাজ পড়া বাধ্যতামূলক না।কিন্তু কেও মৃত্যুবরণ করলে একজনও যদি তার জানাজা না পড়তে আসে তাহলে ওই এলাকার সবাই গুনাহের ভাগীদার হবে। মুলধারার সাহিত্যটাও এরকম। এটা চর্চা করা বাধ্যতামূলক না।কিন্তু কেওই যদি না করে তাহলে সাহিত্যের মান কমে যাবে। একইভাবে জানাজা নামাজ না পড়লে যেমন কাওকে বেনামাজি বলা যাবেনা,তেমনই মূলধারার সাহিত্য না চর্চা করলে কাওকে অলেখক,সস্তা লেখক,বাজারি লেখক ইত্যাদি তকমা দেয়া যাবেনা।


এখন বলি মূলধারার সাহিত্য বলতে ইদানীং কি বোঝানো হয়। যে লেখার পাঠক যত কম,যে বইয়ের বিক্রি যত কম,যে লেখকের পরিচিতি যত কম সেইটা তত উন্নতমানের মূলধারার সাহিত্য। হাস্যকর শোনালেও এখন এটাই চলে আসছে। হুমায়ূন আহমেদ স্যার কিংবা সাদাত হোসাইন ভাইয়ের কথা বাদই দিলাম।বাদ দেয়ার কারণ এটা না যে উনাদের লেখা আসলেও সস্তা। কারণ হলো উনাদের নিয়ে এমন কথা প্রায় সবাই শুনে ফেলেছে ইতিমধ্যে। উনাদের পাঠকপ্রিয়তা দেখে হিংসার বসে অনেক অবান্তর কথাবার্তা মানুষ বলে।কিন্তু ইদানীং দেখতেছি আহমদ ছফা,ড.সলিমুল্লাহ খান,প্রফেসর আব্দুর রাজ্জাক স্যার ইনাদের নিয়েও এসব স্বঘোষিত সাহিত্যিকদের প্রচুর সমস্যা। নিজের নামের সঙ্গে  প্রগতিশীল শব্দটি যোগ করে তারা প্রগতিশীল হয়ে গেলেও তাকে কেও চিনেনা আর ইনারা কেন এত জনপ্রিয় এটা তারা মেনে নিতে পারেনা।এইযে মূলধারার নামে একটা নকল খোলস পরে একটা বলয় সৃষ্টি করেছে তারা,এই বলয়ে প্রতিদিন যোগ হচ্ছে অখাদ্য বই। এখন বই প্রকাশের আগে কেও ভাবে না যে বই বিক্রি না হলে কিংবা পাঠক না থাকলে মানুষ বইটি কে নিয়ে সমালোচনা করবে।কারণ বই বিক্রি না হলে মুলধারার বই বলে ঘোষণা করে দেয়ার সুযোগ আছে।এবং ওই বলয় সৃষ্টিকারী গোষ্ঠী সেই লেখক কে আপন করে নিবে। আত্মতুষ্টি তে তুষ্ট এসব লেখকরা একে অপরের সান্ত্বনা।মূলধারার নামে প্রকৃতপক্ষে অখাদ্য বইয়ের সংখ্যা বাড়তেছে। যেসব বই/লেখক কে এরা সস্তা বলে বা শুধুই মানহিন জনপ্রিয় ধারার সাহিত্য বলে তকমা দেয় সেসব বই যে শুধু বিক্রিই হয় তাই না।সেই লেখকরা সকল প্রকার জাতীয়, আন্তর্জাতিক পুরস্কার থেকে শুরু করে পাঠ্যপুস্তকে নিজেদের জায়গা করে নিয়েছেন। আর উনাদের এত অমূল্য মুলধারার সাহিত্যের একশো টা বইও বিক্রি হচ্ছেনা।
নিজের ব্যর্থতা কে ঢাকার জন্য মূলধারার সাহিত্যের আশ্রয় নেয়াটা শাক দিয়ে মাছ ঢাকার ব্যর্থ চেষ্টা ছাড়া কিছুই না। এসব স্বঘোষিত মানসম্মত লেখকরা আখতারুজ্জামান ইলিয়াস,আবিদ আজাদ সহ আরো অনেক গুণী কবি সাহিত্যিকদের কথা টানবে কিন্তু তাদেরই বলা সেই গুণীজনদের কোনো গুণ তাদের নিজেদের লেখায় খুঁজে পাওয়া যাবে না। 


মূলধারার সাহিত্যের কথা তাদের মুখেই মানায় যাদের আসলেও এই দিকে অবদান আছে।যাদের সত্যিকারের মানসম্মত বই আছে।যারা কাজ করেছেন এই ধারার জন্য।হতে পারে কেও প্রতিষ্ঠা করেছে এমন একটি প্রতিষ্ঠান যেখানে এই ধারার সাহিত্য চর্চা হবে।অথবা কোনো প্রকাশনী যেখানে বইয়ের বিক্রি কিংবা লাভের ঊর্ধ্বে গিয়ে লেখার মান কে প্রাধান্য দিয়ে বই প্রকাশ করা হয়।অথবা হতে পারে কেও মূলধারার সাহিত্যের মানুষদের বাচিঁয়ে রাখার জন্য তাদের লেখা দিয়ে, তাদের সম্পর্কে লেখা নিয়ে কোনো বই বা ম্যাগাজিন প্রকাশ করে যাচ্ছে। এই মানুষ গুলো এই মূলধারার পেছনে তাদের শ্রম,অর্থ দিচ্ছেন ইনাদের মুখে মানায় সাহিত্য মানের কথা।আর সফলতার বিচারেও কিন্তু তারা সফলই।ইনাদের পাঠকও আছে,আছে সাহিত্যে অবদান। 


কিন্তু এরকম মানুষদের সাথে চলাফেরা করে নিজেকেও  মূলধারার লেখক দাবী করে কিছু মানুষ মূলধারার ধারে জনপ্রিয় লেখকদের কচুকাটা করতে ব্যতিব্যস্ত থাকে।এবং জনপ্রিয় লেখকদের সমর্থন করলে,তাদের লেখা পড়লে কিংবা তাদের সাথে সম্পর্ক আছে এমন মানুষদের উপর সরাসরি হামলা করতেও এরা দ্বিধা করে না। অথচ এদের না আছে কোনো পাঠক,না সাহিত্যে কোনো অবদান, না এই মূলধারার পেছনে কোনো শ্রম বা অর্থ বিনিয়োগ।এদের আরো একটি কথা আছে যে প্রকৃত জ্ঞানী সে বিনয়ী হয় না।অথচ জ্ঞান,সম্মান মানুষ কে বিনয়ী করে। যে যত সফল সে তত বিনয়ী এর উদাহরণ দিয়ে শেষ করা যাবেনা।এরা এই কথার মাধ্যমে তাদের ঠাটবাট বজায় রাখতে চায়। একজন সফল মানুষের বিনয় কে এরা ছোটো করে তার দুর্বলতা হিসেবে উপস্থাপন করতে চায়। 


বর্তমান সময় কন্টেন্ট ক্রিয়েশন কিংবা ভিডিও মিডিয়ার দখলে।ফেসবুক,ইউটিউব থেকে শুরু করে টিভি নাটক কিংবা সিনেমা।এখন গ্লোবালাইজেশন এর সুবাদে ভিনদেশী আন্তর্জাতিক খ্যাতিসম্পন্ন সিনেমা কিংবা সিরিজ দেখা খুবই সহজ ব্যাপার। দৈনন্দিন কাজের ফাঁকে অবসর সময় কাটানোর জন্য এসবই যথেষ্ট। এতসব সুযোগের পরেও যদি কোনো লেখকের প্রতিটি বইয়ের ৫০০০+ কপি বিক্রি হয়,যদি কোনো লেখকের কথা শুনতে শতশত মানুষ জড় হয় কোনো মিলনায়তনে, যদি কোনো লেখকের বক্তব্যের ভিডিও তে হাজার টা মন্তব্য আসে,যদি কোনো লেখকের লেখা হাজারবার শেয়ার হয় আমার চোখে সে অবশ্যই একজন ভালো লেখক।আমি তাকে সমর্থন করি।এই মানুষ গুলোর জন্যেই এখনো সাধারণ পাঠক আছে। এই মানুষেরা না থাকলে ওই তথাকথিত মুলধারার বই একজন লিখতো,আরেক লেখক কিনতো। এভাবে একে অপরের মধ্যে বই বিনিময় করে মাসের শেষে দেখা করে একজন আরেকজনের প্রশংসা করে সান্ত্বনা খুঁজে বেড়ানো ছাড়া কোনো প্রাপ্তি থাকতো না লেখকদের।


একটি সাহিত্য আড্ডায় একজন কবির মুখে শুনেছিলাম যে কবিতায় শিল্পমান থাকতে হবে, সমাজের কথাও থাকতে হবে। সমাজের কথা বলতে গিয়ে শিল্পের মান কমানো যাবেনা,আবার শুধু শৈল্পিকতা বজায় রাখতে গিয়ে সমাজ কেও বাদ দেয়া যাবেনা।আমি এরসাথে সহমত। তবে বর্তমান সময়ের প্রেক্ষিতে আমার আরো একটি মত আছে।আমার মতে যদি শিল্পমান এবং সমাজের কথা একসাথে বলা যায় তবে তা উত্তম।সেই লেখাকে স্যালুট জানাই। কিন্তু যদি শৈল্পিকতা বজায় রাখা নাও যায়,তবুও সমাজের কথাটা লিখে যাওয়া জরুরি। শৈল্পিক হয়নি বলে সমাজের কথা লেখাই ছেড়ে দেয়া যাবে না।মৌলবাদী কিংবা সাম্প্রদায়িক শক্তি কিন্তু থেমে থাকবে না।তারা তাদের নেগেটিভিটি ছড়িয়েই যাবে।আর এর বিপরীতে আমরা লেখায় শিল্পের মান আসার অপেক্ষায় বসে থাকলে না থাকবে সমাজ,না শিল্প। শিল্পে মান খুঁজতে খুঁজতে শেষে খুঁজে পাওয়া যাবে তালেবান।


লেখাটি লিখলাম তাদের জন্য যারা এখন যারা নতুন লেখালেখি করছো/যারা করতে চাচ্ছো তাদের জন্য।তোমরা সচেতন হও। তুমি জনপ্রিয় হতে চাইলে হও।এতে কোনো দোষ নেই।এটা অন্যায় না। নিজের পাঠকমহল বানাও।খ্যাতি বাড়াও। তোমার কথা মানুষের কাছে পৌঁছে দাও। সাহিত্যের মান রক্ষা করতে তুমি বাধ্য না। তুমি না পড়লেও অন্য কেও সেই জানাজা পড়বে।তুমি গুনাহমুক্ত। যারা সেই জানাজা পড়তেছে তাদের প্রতি সম্মান রেখে নিজের কাজ চালিয়ে যাও।আর যারা নিজেরা জানাজা না পড়ে তোমাকে বেনামাজি বলে ওদের কে এড়িয়ে যাও।তোমার কাজ নিয়ে ওদের কোনো মাথাব্যথা নেই আসলে।ওরা ব্যস্ত নিজেদের ব্যর্থতা ঢাকতে। 

তোমাদের প্রতি আমার একটি মাত্র আহ্বান তোমার লেখায় যেন সমাজের রক্ষণশীলতা,সাম্প্রদায়িকতা,মৌলবাদ,লিঙ্গ ভেদাভেদ,অন্যায়, অত্যাচারের বিরুদ্ধে কথা থাকে।
তোমার পাঠকমহলের গুটিকয়েক মানুষও যেন তোমার মাধ্যমে সচেতন হয়। তোমাদের কাছে আমার চাওয়া এটুকুই। অতঃপর তোমরা জনপ্রিয় হও।পাঠক বাড়ুক। পৃথিবী বইয়ের হোক।।


লেখক সম্পর্কে

আসিফ খন্দকার। পেশায় একজন লেখক। কবিতা দিয়ে শুরু হলেও প্রবন্ধ আসিফ কে পাঠকদের মাঝে পরিচিতি এনে দিয়েছে।লেখকের জন্ম টাংগাইল জেলার কালিহাতী উপজেলায়।মার্কেটিং বিষয়ে স্নাতক সম্পন্ন করেছেন।

দেশ-বিদেশের বিভিন্ন পত্রপত্রিকায় আসিফের শতাধিক লেখা প্রকাশিত হয়েছে। প্রকাশিত বইয়ের সংখ্যা চারটি। নির্বাচিত কবিতা,অনুকথার শহর,ক্যাম্পাসিয়ানদের কথা, টুকরো চিন্তার দেয়াল (ই-বুক)।এছাড়া তিনটি সাহিত্য ম্যাগাজিন সম্পাদনা করেন। ষান্মাসিক প্রতিভা,কালিহাতীর সাহিত্যাঙ্গন,ষান্মাসিক সুপারহিরো (সহ-সম্পাদক)। 
জড়িত সাংবাদিকতার সাথেও। দৈনিক আলোকিত ৭১ সংবাদে দুবছর সাহিত্য সম্পাদক ছিলেন। শিল্প-সাহিত্য নিয়ে ফিচার লিখেন সকালের শিরোনাম, এটিভি সংবাদ,সোনালি নিউজ সহ অনেক নিউজ পোর্টালে। বিভিন্ন আর্টিস্ট দের নিয়ে আসিফের ৫০+ ফিচার প্রকাশিত হয়েছে এখন অব্দি।
আসিফ খন্দকার আসিফ খন্দকার সম্পাদক, কালিহাতীর সাহিত্যাঙ্গন।