পোস্টস

গল্প

লালী : এক বুক ব্যথার নাম

৯ সেপ্টেম্বর ২০২৩

লাবণী মণ্ডল

মূল লেখক লাবণী মণ্ডল

সবুজে ঘেরা এক গ্রাম ছায়ামতি। মিনহাজ মিয়ার জন্ম পঞ্চগড়ে হলেও বেড়ে উঠা; জীবনের বেশ অর্ধেক কেটে গেছে এ গ্রামে। তবে কথায় আছে না– মানুষ অভ্যস্ততার গোলাম! কয়েক বছর ঢাকায় থেকে, এই পাথুরে নগরীটাকেও সে বেশ আপন করে নেয়। মায়ের মৃত্যুর পর স্ত্রী, এক মেয়ে, এক ছেলে নিয়েও ছিল তার সংসার।

২০১৯ সাল। তখনো করোনার আবির্ভাব হয়নি এ শহরে। সে বছরই ঢাকা ছাড়ে ৫২ বছর বয়সী মিনহাজ ও তার পরিবার। তবে ঢাকায় থেকে যায় পরিবারের বড় কন্যা। খুব বেশি পরিকল্পিতভাবে ঢাকা ছাড়েনি তারা। ঢাকার প্রতি আলাদা মায়াবোধ তাদের বেশ কষ্ট দিয়েছিল; কিন্তু বাস্তবতার কারণে ঢাকা ছাড়তেই হতো।

গ্রামে ফিরে কৃষিকাজ করেই দিনাতিপাত চলছিল। ঢাকা থেকে বড় মেয়ের আর্থিক সহযোগিতা এবং গ্রামে গিয়ে টুকটাক কাজ করে সংসার কোনোমতে টিকেছিল।

ছায়ামতি চারদিকে সবুজ, মুক্ত হাওয়ায় জীবন একেবারে মন্দ কাটছিল না। মিনহাজ মিয়ার খুব শখ হয় গরু–ছাগল, হাঁস–মুরগী পালবে; কিন্তু তার হাতে পুঁজি নেই। ছোট ছেলে চাকরিহারা। মেয়ে একা আর কত সংসারের ঘানি বইবে!

মেয়ে তৃষ্ণা অতিকষ্টের জমানো টাকা দিয়ে, একটি ছোট বাছুর কিনে দেয়। বাড়িতে সবাই আনন্দে মাতোয়ারা হয়ে পড়ে। আনন্দে দিগ্বিদিক ছুটতে থাকে মিনহাজ। তার জীবনে এত আনন্দ, আর কোনোদিন হয়নি।

বাছুরটির গায়ের রঙ লালচে। সবাই মিলে ওর নামকরণ করে ‘লালী’। পুরো বাড়িটাতেই লালী রাজত্ব করে বেড়ায়। মিনহাজ মিয়া দুনিয়াদারি ভুলে ওর পেছনেই লেগে থাকে। এ নিয়ে পাড়ার লোকের নানান টিপ্পুনি থেকে মুক্তি পায় না। ‘আহ্লাদে গদগদ’, ‘মানুষের আর গরু নেই’ এসব কথাবার্তায় বেশ রমরমা পরিবেশ তৈরি হয় পাড়ায়; এতে মিনহাজের কোনো কষ্টানুভূতি হয় না। সে তার মতো লালীকে আদর–যত্নে ভরিয়ে রাখতে থাকে। সবুজ কচি ঘাস দূর থেকে উঠিয়ে এনে লালীর সামনে দিয়ে রাখে। ওটুকু বাছুর কতটুকুই–বা খেতে পারে; কিন্তু মিনহাজের বারবার মনে হয়, লালীর মনে হয় পেটে খিদেই কমে না। রোদে যেতে দেয় না, বৃষ্টির ফোটা পড়তে দেয় না।


মিনহাজের স্ত্রী সমলা বেগমেরও পোষাপ্রাণী খুব প্রিয়। নিজেকে উজাড় করে দিয়ে পোষাপ্রাণীদের ভালোবাসে। আগে ঢাকায় দুটো খরগোশের বাচ্চা পালত। ঢাকা শহরে ঘাসের বড়ই অভাব। সেই বুড়িগঙ্গার চর থেকে ঘাস তুলে খাওয়াত ওদের। পরিবারের সবারই পোষাপ্রাণীর প্রতি আলাদা দরদ রয়েছে। মিনহাজের ছেলের ছয় মাসের কন্যাশিশুটিও সেভাবেই গড়ে উঠছে।

যা–ই হোক, লালী কেনার পর থেকে আস্তে আস্তে খেয়াল হলো, কোনোদিন সে ডাকেনি। ‘হাম্বা’ ডাক কেউ শুনেনি। এটি খুব আলোচনার বিষয় হয়ে পড়ে। মিনহাজের মনটা ভারি হয়ে উঠে। একেক জনের একেক কথা, তাকে বেশ কষ্ট দেয়। লালীর চোখ দিয়ে মাঝেমধ্যেই অঝোরে পানি ঝরে। লালী কেন কান্না করে? মিনহাজ বিস্ময় প্রকাশ করে। আশপাশে বহুজনের দারস্থ হয়। কেউ কোনো সঠিক উত্তর দিতে পারে না।

২০২০ সাল। লালী বড় হচ্ছে। কিন্তু অস্বাভাবিক লক্ষণ দেখা যায়। একদিন কাকডাকা ভোরে লালী পড়ে যায়, তড়পাতে থাকে। পেট ফুলে যায়। মনে হয় শ্বাস নিতে কষ্ট হচ্ছে। মিনহাজ কোনো দিশা পায় না। হাউমাউ করে কাঁদতে থাকে। পরিবারের সম্বল, ভালোবাসা, আদরের ধনের কি হলো বলে– অঝোরে কাঁদতে থাকে। কিছুক্ষণ পরই লালী উঠে দাঁড়ায়। আবার আগের অবস্থায় ফিরে যায়।

এরপর এল করোনার ঘোষণা। সাধারণ ছুটির নামে অঘোষিত লকডাউন চলে। পুরো বিশ্ব মহামারিতে আক্রান্ত হয়। মিনহাজের বড় মেয়ে ঢাকা থেকে বাড়ি চলে যায়। তারও লালীর প্রতি অগাধ ভালোবাসা। লালীকে আদর করে খাওয়ানো, গোসল করানো; এটাই যেন তার অন্যতম কাজ। হঠাৎ এক বিকেলে লালী আবারও পড়ে যায় এবং তড়পাতে থাকে।

তৃষ্ণা ডাক্তার ডাকার জন্য আকুতি জানায়। গ্রামের মেঠোপথ, আইল ধরে সন্ধ্যাবেলা ডাক্তার আসতে সম্মতি জানায় না। কত আকুতি–মিনতি করেও ডাক্তারকে আনা সম্ভব হয় না। পুরো বাড়িতে শোকের মাতম। লালীর কি হলো– সবার প্রশ্ন একই! কেউ বলে ‘গ্যাস’ জমেছে, কেউ বলে ‘জ্বিনের’ আছর লেগেছে; কিন্তু জ্বিন–ভূতে বিশ্বাস করে না মিনহাজ। ওসব জ্বিন–ভূতের কথা কানেও নেয় না।

এরপর থেকে সপ্তাহে দুইদিন লালী এ রকম পড়ে যেত, আর তড়পাতে থাকত। পরিবারের জন্য এটি অত্যন্ত কষ্টের কারণ হয়ে দাঁড়ায়। বহু জনের বহু পরামর্শ। পরিবারের সবাই মিলে সিদ্ধান্ত নেয়, লালীকে বিক্রি করে দেওয়ার; কিন্তু মিনহাজ বরাবরই ঘাড়তেঁড়া ব্যক্তি। তার এসব কথাবার্তা একদম পছন্দ না। কাঁদতে থাকে। খেতে চায় না। অস্বাভাবিক আচরণ করতে থাকে। লালীর প্রতি অতিরিক্ত ভালোবাসাই তাকে এ রকম পরিস্থিতিতে ফেলে দেয়। বাস্তবতাকে মানার মতো জ্ঞানবুদ্ধি হারিয়ে ফেলে সে।

এক শুক্রবার দুপুরে লালী আবারও পড়ে যায়। এবার অবস্থা অনেকটাই সিরিয়াস। দেড়ঘণ্টা লালী আর উঠে দাঁড়ায় না। সবাই আশা ছেড়ে দেয়। পরিবারের সবাই চুপ করে আছে। সিদ্ধান্ত হয় লালীকে বিক্রি করে দেওয়ার। লকডাউন পরিস্থিতি ভালো হলেই তাকে হাটে তোলা হবে। মিনহাজ নিমরাজি হয়; কিন্তু যখনই বাড়িতে কোনো গরুর পাইকার আসে, সে অস্বাভাবিক হয়ে যায়। আবোল–তাবোল বকতে থাকে। পরিবারের সবাইকে ‘নিষ্ঠুর’, ‘নিমকহারাম’ বলে গালি দিতে থাকে। ‘পরিবারের কোনো সন্তান যদি অসুস্থ হতো, তাহলে তাকে বিক্রি করে দেওয়া যেত…’! এসব বকতে থাকে।

ডাক্তারের শরণাপন্ন হয় মিনহাজ। ডাক্তার রোগের বর্ণনা শুনে স্পষ্ট জানিয়ে দেয়, এ রোগ ভালো হবে না। মিনহাজ এবার আরও ভেঙে পড়ে। রোগের নাম ‘তড়কা’। সে এবার রাজি হয়, বিক্রি করে দিতে হবে। নতুন ‘লালী’ ওই হাটবারেই কিনতে হবে।

সোমবার, হাটবার। লালীকে সকাল থেকে সবুজ কচি দূর্বাঘাস খাওয়ানো হয়েছে। সাবান দিয়ে ডলে ডলে, বেশি করে পানি দিয়ে গোসল করানো হয়েছে। লালী সকাল থেকেই কাঁদছে। কেমন অদ্ভুত পরিস্থিতি! বাড়ির সবাই চুপচাপ। কারো মুখে কোনো শব্দ নেই। খাওয়া–দাওয়া বন্ধ। লালীর মুখে–গলায় হাত বোলাচ্ছে মিনহাজ। এক বোতলের অর্ধেক সরিষার তেল মেখে চিকচিক করে ফেলেছে। লালী মাথাটা গুঁজে দেয় মিনহাজের ঘাঁড়ের উপর। কেমন আদর চায়, যেন কতদিন আদর পায়নি!

মিনহাজের চোখের পানিতে লালীর গলা ভিজে যাচ্ছে। দুজনের চোখের পানিতে একাকার। অবশেষে আইল ধরে লালীকে টেনে নিয়ে যাওয়া হচ্ছে। লালী বারবার পেছন ফিরে তাকায়। খুটি মেরে দাঁড়িয়ে থাকে। জেদ করে, যাবে না, এ বাড়ি ছেড়ে!

মিনহাজ অনিচ্ছাসত্ত্বেও লালীকে চড় মারে। জোরে টান মারে। লালীর জেদ বেড়ে যায়। বাড়ির অন্য সদস্যরা ঘরে লুকিয়ে থাকে। শুধুমাত্র মিনহাজের স্ত্রী পেছন পেছন যায়, ঘামের গন্ধ ভরা শাড়ির আঁচল দিয়ে বারবার চোখ মুছে দেয়। এ বড় মায়া। এ দৃশ্য দেখার মতো নয়!

নাহ্! সেদিন লালীকে মিনহাজ বিক্রি করে না। বাজারে নেওয়ার পর না–কি লালী ‘হাম্বা’, ‘হাম্বা’ করে অনবরত ডাকতে থাকে। মিনহাজ সুফি মতাদর্শকে বিশ্বাস করে, চিন্তায় সুফিবাদ ধারণও করে। তার ভেতর জানান দেয়, লালী ভালো হয়ে গেছে। ফিরিয়ে নিয়ে আসে। বাড়ির সবাই অবাক! সে মিথ্যা কথা বলে, লালীর দাম নাকি খুব কম উঠেছে!

বাড়িতে এক ধরনের খুশির আমেজ। লালীকে সবাই আদর করছে যার যার মতো। বৃহস্পতিবার দিন কাকডাকা ভোরে লালী আবারও পড়ে যায়। পেট ফুলে যায়। শ্বাস নিতে কষ্ট হয়। বাড়ির সব গাছগুলোর পাতা যেন আর নড়ছে না। যে যেখানে সেখানোই থ’ মেরে দাঁড়িয়ে থাকল। লালী আর উঠে না। এবার হয়তো আর উঠবে না বলে কাঁদতে থাকে মিনহাজের স্ত্রী। বাঁধভাঙা কান্নার ধ্বনিতে আকাশ–পাতাল একাকার হয়ে যায়; কিন্তু কান্না থামে না!

লালী আবারও উঠে দাঁড়ায়। কচি কাচা ঘাস চিবুতে থাকে। কী সুন্দর দৃশ্য! এত চমৎকার গরু আর কারো হয় না! কী সুন্দরভাবে চিবোয়; কিন্তু মিনহাজ এবার মনে মনে স্থির করে তাকে সামনের হাটবারে বিক্রি করে দিবে। আর দেরি নয়…!

সোমবার। দুপুর গড়িয়ে যায়। মিনহাজ বাড়ি ফিরে না। আজ তো লালীকে হাটে নেওয়ার কথা। কোথা থেকে দৌড়ে দৌড়ে মিনহাজ বাড়ি আসে। লালীকে আগেই সাজিয়ে–গুজিয়ে রাখা হয়েছিল। লালী এবারও জেদ ধরে; কিন্তু মিনহাজ এবার দৃঢ়। বাড়ি থেকে হাটবাজার আধঘণ্টা পথ। হেঁটেই যাবে, স্থির করেছে। হাঁটছে। লালী বেশ তিড়িংবিড়িং করছে। কেমন পুরো সড়ক মাতিয়ে রাখছে। মিনহাজ যেন স্বপ্ন বেচার জন্য যাচ্ছে। তার চোখে–মুখে অন্ধকারের ছায়া। ভেবে রেখেছে আরেকটি লালী কিনে নিয়ে তবেই বাড়ি ফিরবে।

ব্রিজ পেরিয়ে গ্রামের হাট। সেটি পার হয়ে দুপাশে বিশাল বিল। বর্ষাকাল। চারদিকে থৈ থৈ করছে। মিনহাজ অবাকবিস্ময়ে এদিক–ওদিক তাকিয়ে সৌন্দর্য অবলোকন করছে। আর বিড়বড় করছে, কত লোকে, কত পশু হত্যা করে– আমার ক্যান এত কষ্ট!

পথ যেন ফুরোয় না। হঠাৎ আকাশ ভেঙে পড়ে মাথায়। একটি মটরসাইকেলের হুঁইসেলে লালী লাফ দিয়ে পড়ে যায় বিলে। মিনহাজের হাত থেকে দড়ি ছুটে যায়। সে দিগ্বিদিক হারিয়ে, বিলে নেমে যায়। না, লালীকে খোঁজে পাওয়া যাচ্ছে না। সে সাঁতার কাটছে। পথচারীরা জমে গেছে। ‘লোকটাকে বাঁচাতে হবে, এই লোকটা মরে যাইবো তো…’ এসব বলে পথচারীদের কেউ একজন তাকে বিল থেকে উঠায়। ইতিমধ্যে ২০ মিনিট পার হয়ে গেছে।

জোরজবরদস্তি করে মিনহাজকে রাস্তার কিনারে উঠানো হয়। সে আবারও নেমে যেতে যায়। লোকজন ধরে রাখে। তার কান্নার ধ্বনিতে পুরো রাস্তা কেঁপে উঠে, চেনা–অচেনা কত লোকের চোখের পানি ঝরে! এটাই বুঝি মায়ার দুনিয়া! ‘আমার লালী কই, আমার লালী….’ বলে চিল্লাতে থাকে মিনহাজ! সবাই থ’মেরে থাকে।

বাড়ির লোকজন অপেক্ষার প্রহর গুণছে। কখন আসবে নতুন লালী। তাকে তো বরণ করতে হবে। কেমন খুশির আমেজ বিরাজ করছে। আচমকা এক খবরে পুরো বাড়িতে কান্না রোল পরে যায়। মিনহাজের স্ত্রী দৌড়াতে থাকে হাটের দিকে। মাঝপথে দেখা হয় মিনহাজের সঙ্গে। সে ভেজা কাপড়ে পাগলের মতো ঝুলে ঝুলে হাঁটছে। ‘লালী কই’বলে গ্রামের বাজারেই পরে যায় মিনহাজের স্ত্রী। বাজারের লোকজন তাকে দেখিয়ে আনে, দূর–দিগন্তে লাল টকটকে একটি সৌন্দর্য ফুটে উঠেছে– ওই সৌন্দর্য ফোটা বিলেই লালীর ভেসে আছে!

‘ওই যে, ওই তো আমার লালী, কলিজার ধন– ওরে আইনা দেন ভাইরা আপনারা…!’ লালী আর ফিরেনি। শহরে বাস করা তাদের মেয়ে এ খবর পেয়ে ডুঁকরে কেঁদে উঠে। এ যন্ত্রণা এখনো বয়ে বেড়ায়।

মিনহাজ অস্বাভাবিক হয়ে যায়। ঠিকমতো কোনো কাজই তার দ্বারা সম্ভব হয় না। শোক একটু কাটিয়ে উঠলে, তাদের কন্যা বাবা–মাকে খুশি করার জন্য আরও একটি ‘লালী’ কিনে দেয়, এর কিছুদিন পর আরও একটি ‘লালী’ কিনে দেওয়া হয়; কিন্তু লালীকে হারানোর শোক, মিনহাজ ভুলতে পারেনি।

গ্রামের লোকজন প্রায়ই বলে, ‘আরে মিনহাজ ভাই, পশু–পাখি পাললে মরতে পারেই, তাইর জইন্য আপনার এমুন করা নাগব…!’ মিনহাজ কারো কথায় আশ্বস্ত হয় না। প্রথম লালীর প্রতি যে ভালোবাসা ছিল, তা আর পরের লালীদের জন্য জন্মায় না।

সবকিছুই স্বাভাবিক চলছিল। লালীরা পোষ মেনেছে। আদর–যত্ন মিনহাজের স্ত্রী সমলা বেগম করছে। এর মধ্যে তাদের তিনটি ছাগল মারা যায়। যেটি তাদের কষ্টকে আরও বাড়িয়ে দেয়। কষ্টগুলো যেন পেয়ে বসে, ও রকম একটি সুখী পরিবারে– একের পর এক হারানোর ব্যথা, মিনহাজের মতো আবেগী মানুষকে ধুঁকে ধুঁকে মেরে ফেলার শামিল করে। তবুও স্বপ্ন বোনে। বাড়ির পাশে সবুজে ভরপুর। কত রকমের সবজি লাগিয়েছে। সেবার ফলনও বেশ হয়েছে। একের পর এক কষ্ট কাটানোর চেষ্টায় জমে থাকে স্বামী–স্ত্রী দুজনই।

হঠাৎ একদিন মিনহাজ জ্বরে আক্রান্ত হয়। তার ছেলের বউ জ্বর মেপে জানায় ১০৮ ডিগ্রি সেলসিয়াস! তখন মিনহাজের ছেলে–মেয়ে দুজনই ঢাকায়। এ খবর মুহূর্তেই ছড়িয়ে যায়। না, এটি অস্বাভাবিক! ভুল হচ্ছে কোনো! একের পর এক ডাক্তারের শরণাপন্ন হতে থাকে তৃষ্ণা। সবাই তাকে হাসপাতালে ভর্তি করানোর পরামর্শ দেন। তখন করোনার ঊর্ধ্বগতি। ২০২০ সালের সেপ্টেম্বর মাস।

মিনহাজের ছেলে সবকিছু ফেলে বাড়ি চলে যায়। বাবার এ অসুস্থতা তাকে পাগল করে তোলে। ঢাকায় বসে মেয়ে কিভাবে, কি হবে ভেবে অস্থির! কোনো রকমে রাত্রি পার হয়। পরদিন সকাল আটটায় হাসপাতালে নেওয়া হয়। ডাক্তাররা তাকে কোভিড হাসপাতালে ট্রান্সফার করে।

অ্যাম্বুলেন্স চলছে। তখনো মিনহাজ জ্ঞান হারাইনি। ছেলেকে জড়িয়ে ধরে বারবার বলছে, ‘বাবা আমার চিকিৎসা করাবে না…!’ ঢাকা থেকে মেয়ে অফিস ছুটি নিয়ে বাড়ির পথে রওনা হয়। কিছুক্ষণের মধ্যে খবর ছড়িয়ে যায় , ‘মিনহাজ নেই…!’ স্তব্ধ! নিস্তব্ধ! বাকরুদ্ধ! এটি কী কোনোভাবেই মেনে নেওয়া সম্ভব! কী কারণে এমন হলো!

আকাশে–বাতাসে রটে যায়, মিনহাজ লালীর শোকে মারা যায়। লালীর মৃত্যু তাকে পৃথিবীতে বেঁচে থাকার আশা কেড়ে নেয়। লালীর প্রতি অগাধ ভালোবাসাই তার অস্বাভাবিক মৃত্যুর জন্য দায়ী! তার পরিবার, তার মেয়ে আজও নিজেদের সান্ত্বনা দিতে পারেনি নিজেদের– কী এমন অপরাধের কারণে এমনটি হলো।

পোষাপ্রাণীর প্রতি প্রেম একজন ব্যক্তিকে শেষ করে দিতে পারে। ভালোবাসা একজন মানুষকে নিঃশেষ করে দিতে পারে। এ ঘটনার পর বিশ্বাস করতে থাকে তার মেয়ে। তার ভেতরেও বারবার এই চিন্তাই উঁকি দেয়, বাবাকে হারিয়েছি সেদিনই, যেদিন লালীকে হারিয়েছি। লালীর ব্যথাই, বাবার ব্যথা হয়ে উঠেছিল। আজ লালী নেই, বাবাও নেই; কিন্তু স্মৃতিগুলো রয়ে গেছে। হয়তো, মৃত্যুর আগপর্যন্ত এই স্মৃতির ভার বহন করতে হবে।

লালীর অপূর্ণতা, মিনহাজের অপূর্ণতা ভুলতে পারেনি পরিবারটি। এটিই বুঝি ভালোবাসার স্বাক্ষর। পৃথিবীতে এখনো ভালোবাসা বেঁচে রয়েছে বলে বিশ্বাস রাখতে চায় পরিবারের সবাই!

সামনের মাসের ১০ তারিখ মিনহাজের প্রথম মৃত্যুবার্ষিকী। কেমন করে একটি বছর চলে গেল, এ কথা ভাবতে ভাবতে তার মেয়ের অস্বস্তি বাড়ছে। এটিই বুঝি পৃথিবীর নির্মম সত্য। মৃত্যুই একমাত্র সত্য, আর সব মিথ্যে!