পোস্টস

গল্প

কর্তী সংসার

৬ মে ২০২৪

এম. শিহাব

মূল লেখক এম. শিহাব

মামা তোমার ভর্তা অনেক জোস হইছে, চিংড়ি ভাজা কি আছে, আরেকটু দাও। 
না মামা চিংড়ি শেষ। বলেই কড়াইয়ের ঢাকনা উঠিয়ে পিঠা দেখে আবার ঢাকনা লাগিয়ে রাখলো মনসুর।
এত ভালো হয় ভর্তা গুলা আর এই  চিংড়িটাই শেষ হয়ে যায় কেনো তোমার, বেশি করে আনতে পারো না, একটা দিনো এসে চিংড়ি ভাজা পাই না ঠিক মত। দেখো ভালো করে আছে কিনা। শ্যামা কিছুটা বিরক্তি নিয়েই বলল।
মনসুর নিচ থেকে এক এক করে বাটি বের করে চিংড়ির বাটিটা খুজে বের করলো। যেই সে বাটিটা খুলল আর শ্যামা প্রায় চিৎকার দিয়ে উঠলো দেখছো পুরা বাটি ভর্তি চিংড়ি পরে আছে। কি সমস্যা কি, চিংড়ি কি সব বাসায় নিয়ে যাবা?
সৈকতও গলা চড়ালো, তখন যে বললাম চিংড়ি দাও, নাই বললা কেনো ?
মন্সুর কাচুমাচু মুখ করে আসতে আসতে বলল, মামা চিংড়ি দিলেই সবাই মুঠ কইরা খায়া ফালায় তাই উঠায়া রাখি অল্প অল্প দেই।
আমরা কি তোমার এখানে একটা দুইটা পিঠা খাই দুই জনে কম করে হলেও প্রত্যেকবার বিশটা করে খাই আবার বাসায়ও নিয়ে যাই। 
মন্সুর এবার গলায় একটু জোর দিয়ে বলল আপনাদের দিতে গেলে আর সবাইরেও দেয়া লাগবে, আর যখন পার্সেল নেন তখন তো আলাদা করে চিংড়ি দিয়াই দেই সব সময়।
আচ্ছা, আচ্ছা দাও এখন খাই আগে। সৈকতের আর এই চেচানো ভালো লাগছে না, সে এখন চিতই পিঠায় ঝাল-ঝাল ভর্তা মাখিয়ে শীতের রাত আর জিহ্বায় ঝালের অনুভুতি নিতে চায়।
শেষ আমি আর পারবো না, তালু জ্বলতেছে ঝালে। বলতে বলতে শ্যামা বাটিথেকে দুইটা মিষ্টি বড়ই তুলে মুখে দেয়। সৈকত তখনো খেয়েই যাচ্ছে। 
শ্যামা ওর দিকে তাকিয়ে জিজ্ঞাসা করে, বাসায় নিবা পার্সেল ?
সৈকত খেতেখেতেই বলে নাও। নাও। আলুভর্তাটা ঝাল বেশি ওইটা নিও না, সরিষা আর ডাল ভর্তাটা নাও দুইটা মিক্স করে সেই টেস্ট। ও আর তোমার জলপাইয়ের আচারটাও নিও।
মামা কাগজ দাও। শ্যামা কাগজে করে একে একে বাটি থেকে ভর্তা তুলে কাগজে মুড়ে নিলো।
মামা ছাব্বিশটা হইছে আরো চারটা দিয়ে ত্রিশটা দাও আর বেশী করে চিংড়ি দাও, বলে শ্যামা ব্যাগ থেকে টাকা বের করল।
মন্সুর টাকাটা নিয়ে কাগজে মুড়ে চিংড়ি দিলো আর বিড়বিড় করতে থাকলো, প্রত্যেকটা দিনই আসবো আর চিংড়ি চিংড়ি কইরা মাথা খাইবো, নিজেরা বাসায় চিংড়ি আইনা ভাজতে পারে না।
শ্যামা আর সৈকত রিক্সায় করে বাসার সামনে এসে নামল। শ্যামা রিক্সা ভাড়া দিতেছে আর সৈকত সিগেরেটের দোকানের দিকে এগোলো।
আরে দাঁড়াও না, আমি আসতেছি তো। শ্যামা পিছন থেকে চিৎকার দিলো।
সৈকতের ওদিকে মন নেই সে জোরে পা চালালো। তার এখন জিহ্বায় ঝাল আর এই ঝাল মুখে সিগারেট টানার সুখ থেকে সে নিজেকে বঞ্চিত করতে চায় না।  
মামা এক প্যাকেট ব্লাক দেন আর এক প্যাকেট বেন্সন।
কি হল ডাকলাম শুনলানা। হাপাতে হাপাতে বলল শ্যামা।
আরে আমি তো সিগেরেট নিতেছি।
হুম নাও নাও। শ্যামার মুখে দুষ্ট হাসি খেলে গেলো।
সৈকত সিগেরেটের প্যাকেট খুলে একটা সিগেরেট ধরিয়ে বুক ভরে টান দিলো। 
মামা টাকা।
সৈকত যেনো শোনেইনি সে বাসার গলির দিকে হাটা শুরু করলো।
এই টাকা না দিয়ে কই যাও।
সৈকত পিছন ফিরে তাকাই একটা দুষ্ট হাসি দিলো।
শ্যামাও নাছোরবান্দা, আমি দেবো কিভাবে আমাকে তো ফেলেই আসছো।
সৈকত যেনো শুনেইনি সে হেটে বাসার দিকে চলে যাচ্ছে, শ্যামা তাড়াতাড়ি টাকা দিয়ে সৈকতকে ধরতে দৌড় দিলো।
আহারে মেয়েটা, এই কুলাঙ্গার পোলাটারে কোনদিন টাকা দিতে দেখলাম না সব সময় মাইয়াটাই দেয় ।আক্ষেপ করে বলল সিগেরেট বিক্রেতা জিল্লুর চাচা।
আর বইলেন না চাচা বউয়ের খায়, যে কয়দিন গেছি এদের বাসায় কাজ করতে ভাবীই সব টাকা দেয়, অনেক ভালো মানুষ বকশিসও দেয়। এমন বউরে রাস্তায় ছাইড়া দৌড়ায় কেউ। অভিযোগের সুরে বলল সৈকতদের বিল্ডিংয়ের ইলেক্ট্রিক টেকনিশিয়ান রাজু।
চাচা ভাঙ্গা গলায় বলা শুরু করল, হ, বাবা-মায়ের কথা না শুনলে এমনই হয়। দেখো গিয়া পালায়া বিয়া করছে । এখন মাইয়াডা আর কই যাইবো। আটকা পরছে ফাদে। আমার মাইয়াডাও পালায়া গেছিলো এখন পোলার বাড়ি থেইকা ডিমান্ড দেয় বাইক লাগবে, টিভি লাগবে, ফ্রীজ লাগবে। কয় দিন আগেই পঞ্চাশ হাজার টাকা নিয়া ইন্ডিয়া গেছে কি না কি ব্যবসা করবে আল্লাহই জানে। 
আপনে দেন ক্যান, টাকা কি গাছত ধরে চাইলেই দিয়া দেন দেইখাই তো বার বার চায়, আমার বইনের জামাই একবার চাইছিলো সব ভাইয়েরা মিল্লা ওর বাসায় গিয়া এমন মাইর দিছিলাম একবার, তাতেই হইছে এহন উলটা ইদের সময় জামা কাপড় কিন্না দেয় আমগোরে।
 না দিলে মাইয়াডারে মারে বাবা।  এই বুড়া বয়সে মাইয়ার কষ্ট কোন বাপে দেখতে পারে বল। আর আমার তো কোন ছেলে নাই, দুইটাইতো মাইয়া আমার কত কষ্টে মা মরা এই মাইয়া গুলারে বড় করছি। 
রাজুর ফোন বাজে সে চাচার হাতে সিগেরেটের টাকা দিয়ে দৌড় দেয় বিল্ডিংয়ের দিকে।
শোন তুমি আর এই চাচার কাছ থেকে সিগেরেট কিনবানা। দরজা দিয়ে ঢুকতে ঢুকতেই শ্যামা বলে।
কেনো কি হইছে?
আমি বলছি কিনবানা ব্যস, ওনার কাছ থেকে কিছুই কিনবানা।
আচ্ছা কিনবোনা, ফিরেও তাকাবোনা। এখন যাও ফ্রেশ হও।
শ্যামা রাগে গজ গজ করতে করতে রান্না ঘরে যায়। সৈকত রুমে ঢুকেই পিসি অন করে।
এই শোন, কি দেখবা হিন্দী ডাব তামিল নাকি সিরিয়াল ?
শ্যামা রান্নাঘর থেকেই চিৎকার দেয়, তোমার যা ইচ্ছা। 
সৈকত একটা তামিল হিন্দী ডাবিং সিনেমা বের করে, শ্যামা রুমে ঢুকেই বলে, দেখছি এটা। আর এখন কিছু দেখবো না ঘুম পাইছে।
ওকে ঘুমাও তাইলে আমি দেখি।
না তুমিও ঘুমাও আমি একা ঘুমাবো নাকি।
সৈকত বুঝে আজ আর কিছু করা যাবে না, সে পিসি বন্ধ করে ফ্রেশ হয়ে বিছানায় শুয়ে পরে। তার মাথায় অনেক চিন্তা এখন, শ্যামাকে কি বলবে না থাক  কাল সকালে সারপ্রাইজ দিবে। এদিকে শ্যামাও শুয়ে পড়ে চোখে রাজ্যের ঘুম তার অনেক কিছু বলার আছে সৈকতকে কিন্তু এখন না সকালে বলবে।
এই ওঠো আটটা বাজে অফিসের লেট করবা আজকেও।
আরেকটু ঘুমাই প্লীজ, আজ অফিস যাবো না।
যাবা না মানে আমি পাঠাওতে কল দিতেসি চলে আসবে দশ মিনিটেই।
উফ এত জ্বালাও না তুমি। অনিচ্ছা সত্বেও উঠে রেডি হল সৈকত।
শ্যামা টাকা দাও জলদি।
শ্যামা রান্না ঘর থেকে বের হয়ে আসল। কিসের টাকা আজকে তো বেতন পাবা।
তো যাওয়ার ভাড়া লাগবেনা। সৈকত একটু অবাক হল
না এত যাওয়া আসার ভাড়া দেয়া যাবে না, প্রতিদিন তোমার এই যাওয়া আসার ভাড়ায় কয় টাকা যায় হিসেব করছো।
আচ্ছা অফিস যাবো এখন এইসব নিয়ে কথা না বলি এসে বলবনে।
হ্যা অফিসই তো সব, অফিসেই পরে থাকো।
আজব জ্বালা তো, হয়েছে কি বল তো?
কত বার করে বলছি গাড়ি কেনো গাড়ি কেনো একটা, শুনো আমার কথা একটাও।
আমিও তো বলছি কিনবো কিনবো।
কবে কিনবা, আমার আজকেই চাই আর অপেক্ষা করতে পারবো না আমি।
হইছে এখন অফিসে যাই এসে এই নিয়া মহাভারত করবনে। পাঠাও তে কল দিছিলা। বলে সৈকত মোবাইল চেক করতে থাকে।
লাগবে না দেয়া, টেবিলের উপর চাবি, গ্যারেজে গাড়ি আছে, ভেতরে  তোমার লাইসেন্স আর কাগজ-পত্র সব রাখা আছে সব।
সৈকতের কলিজার মধ্যে যেনো কামান দাগলো কেউ, সে খুশি হবে না রাগ হবে বুঝতে পারে না, শ্যামার হাত ধরে একটানে বুকে নিয়ে জড়িয়ে ধরে।
হইছে হইছে যাও তোমার অফিসে যাও। আর গাড়ি তোমার পছন্দ হয় কিনা গিয়ে দেখো। 
সৈকত টেবিলের উপর থেকে ছো মেরে চাবি তুলে নিয়ে দৌড় দেয়। লিফট থেকে সিড়ি তাও দোতালা নেমে আন্ডারগ্রাউন্ডে পার্কিং, এত দূর কেনো। গ্যারেজে তেরপল দিয়ে ঢাকা গাড়ি। সহ্য হয় না আর সৈকতের একটানে তেরপল উঠায় সে আর বেরিয়ে আসে লাল কালারের টয়োটা ভিটজ। কালার দেখে সৈকতের একটা ভ্রূ একটু উপরে উঠে যায়। তেরপল গুছিয়ে গাড়িতে স্টার্ট দেয় সৈকত। গাড়ি গ্যারেজ থেকে বের করে জানালা খুলে দেয়। কে জানে কখন থেকে পরে ছিলো ভেতরে বাতাস ঢুকুক। গলির মুখ দিয়ে বের হতেই চোখে পড়ে জিল্লুর চাচা দোকান নিয়ে বসে আছে পাশে রাজু। এই দুইটা সারাদিনই বসে থাকে এখানে। গাড়ি চালিয়ে আস্তে আস্তে গলির মুখ থেকে বের হল সৈকত। 
রাজু চিৎকার দিলো মামা নতুন গাড়ি। 
সৈকত একটা হাসি দিলো আস্তে আস্তেই রাস্তায় উঠালো গাড়ি সে। তিনবছর হল কোন গাড়িতে হাত দেয়নি। আর এখন নিজের গাড়ি হাত কাপছে। পিছন থেকে কানে আসছে রাজু জিল্লুর চাচাকে বলছে দেখছেন বউয়ের টাকায় এখন গাড়ি হাকায়া চলে। গাড়ি শক্ত হাতে ধরে আস্তে আস্তে স্পীড বাড়ায়। 
নতুন গাড়ি নিয়ে জ্যামে বসে আছে সৈকত। মাথার ভেতর নানান স্মৃতি খেলা করছে। এই তো তিন বছর আগের ঘটনা সৈকতের আর শ্যামার বিয়েটা হুট করেই ওঠ ছেড়ী তোর বিয়ের মত করে হয়ে যায়। মা মরা মেয়ে শ্যামা। বাবা প্রাইভেট ইউনিভার্সিটির ইংরেজীর অধ্যাপক সাইফুর হোসেন। হঠাত ক্যান্সার ধরা পরে তার, ডাক্তার সময় বেধে দেয় তিনমাস। মেয়ের জন্য হারিকেন দিয়ে পাত্র খোজা শুরু হয়। সাইফুর হোসেনের ছাত্র তিহানের মাধ্যমে পরিচয় হয় সৈকতের সাথে তার। সৈকত তখন নতুন জবে ঢুকেছে মাত্র, ইভেন্ট হাউজে কপিরাইটার। মাসে পচিশ হাজার টাকা বেতন। শ্যামার বাবা প্রথম দেখাতেই গ্রাম্য কবি কবি ভাবের সাধাসিধা ছেলে সৈকতকে ভালো লাগে। আর বাবার শেষ ইচ্ছা রাখতেই শ্যামাও বিয়ে করে সৈকতকে। বিয়ের রাতেই শ্যামা সৈকতকে বুঝিয়ে দেয় সংসারের কর্তী সে তার কথাই শেষ কথা। সৈকতও ভদ্র ছেলের মত মাস শেষে বেতন এনে বউয়ের হাতে তুলে দেয় সবটা।  শ্যামা তার এই সরলতার সুযোগ নেয়নি সে উলটো নিজের সংসার আরো গুছিয়ে নেয়। সৈকতের প্রতিদিনের যাওয়া আসা থেকে শুরু করে তার বাবা মায়ের কাছে টাকা পাঠানো, ঘরের যাবতীয় খরচার হিসাব কিতাবের সব দায়িত্ব নিজের করে নেয় সে।  জীবনের সব গুরুতর দায়িত্ব থেকে মুক্ত সৈকত কাজে আরো মনযোগী হয়। নিজের লেখা বই ছাপায় একের পর এক। আর সেই টাকায় প্রথম সারপ্রাইজ দেয় শ্যামাকে নিজেদের ফ্লাট কিনে। তিন বছরে সৈকতের চাকরী বদল হয়েছে পদন্নতি হয়ে এখন মাসের বেতন প্রায় একলাখ কিন্তু হাউজ রুল অনুযায়ী এখনো টাকা সব থাকে শ্যামার কাছে। আর বই বিক্রির টাকা থাকে সৈকতের কাছে। আজ বেতন পেলেই গাড়ীর টাকা হয়ে যেত কিন্তু শ্যামা যে তাকে এভাবে সারপ্রাইজ দিবে সেটা ভাবতেও পারে নাই। সৈকতের চিন্তায় বাধা পরে ফোন বাজছে। শ্যামা ফোন দিয়েছে।  
নিজের সুখ সুখ ভাবটা চাপিয়ে রেখে গলার খুব বিরক্তি এন সৈকত ফোন ধরে,
হ্যা বল।
গাড়ী পছন্দ হয়েছে জনাব?
না জঘন্য
শ্যামা ভয়ে ভয়ে বলে কেনো পছন্দ হয় নাই?
সব সময় তোমার পছন্দই সব, আমার কি কোন পছন্দ নাই?
কিন্তু গত কয়মাস ধরে নেটে বসে সারারাত এইটাই তো দেখতা।
আরে এইটা কোন কালার হইলো, আমার সাদা পছন্দ বলছিলাম তোমাকে।
জ্বী বলছিলেন কিন্তু আমার লাল ভাল্লাগছে।
তো সেটাইতো নিজের পছন্দটা আমার উপরে চাপিয়া দাও সব সময় তুমি।
খুব ভালো, এখন সাবধানে গাড়ি চালাও। রাতে তাড়াতাড়ি ফিরবা।
পারব না লেট হবে, ক্লায়েন্ট মিটিং আছে।
বুঝছি।
সৈকত গাড়ি ঘুরায় নাহ আজ আর অফিসে যাবে না সে। আজ সারাদিন ঝগড়িটার সাথে ঝগড়া করে কাটাবে, আজ ঝগড়া দিবস। বাসার সামনের গলিতে এখনো জিল্লুর চাচা আর রাজু বসে গল্প করছে, হয়ত সৈকত আর শ্যামাই তাদের একমাত্র সাবজেক্ট। সৈকত এসব নিয়ে ভাবে না, তার ঠোটের কোনে এক চিলতে দুষ্টামির হাসি।