পোস্টস

গল্প

শেষযাত্রা

৬ মে ২০২৪

এইচ এম নাজমুল আলম

মূল লেখক এইচ এম নাজমুল আলম

আমি সুইসাইড করেছি ৪ ঘন্টা আগে। ফ্যানের সাথে আমার লাশ এখনো ঝুলছে। রুমের দরজা বন্ধ করেছিলাম। তাই এখনো কেউ বুঝতে পারে নি এ রুমে কেউ মরে ঝুলে আছে। 

আমার অস্তিত্ব এখন বস্তুগত ও অবস্তুগত জগতের মাঝামাঝি। আমি আশেপাশের পরিবেশ সম্পর্কে সচেতনভাবে সবকিছু বুঝতে পারছি, কিন্তু বস্তুগত জগতের স্বাদ, গন্ধ কিংবা কোন অনভূতি টের পাচ্ছি না৷ এটাই কি আত্মার স্বরূপ? আমি জানি না। 

ঘটনা ঘটে বিকাল ৪টায়। এখন ঘড়িতে রাত ৮টা। কেউ কোন প্রয়োজনে আমার রুমে আসে নি, তাই বুঝতে পারে নি আমি মারা গেছি৷ 

জীবন নিয়ে আমি হতাশ ছিলাম না, বিরক্ত ছিলাম। সকাল বেলা ভার্সিটিতে গিয়েই হোচট খেলাম। আজ মিডটার্মের খাতা দিলো। ভেবেছিলাম অন্তত সর্বোচ্চ মার্ক না পাই, দুই এক মার্ক কম হলেও ভালোই করব। অথচ ১৫ তে পেয়েছি ৬.৫। হাতে খাতা নিয়ে উল্টে পাল্টে দেখলাম প্রতিটি প্রশ্নে লাল কালির দাগ৷ দুই এক করে যে মার্ক পেয়েছি সবটাই স্যারের দয়াতে৷ আমি ক্লাসে সব সময় ভালো রেসপন্স করতাম বলেই হয়ত স্যার দয়া করে মার্ক দিয়েছেন। 

সেমিস্টারের এই কোর্সটা আমার খুব পছন্দের ছিলো। খুব ভালোভাবে বোঝার চেষ্টা করতাম। না বুঝলে ক্লাসে বারবার স্যারকে প্রশ্ন করতাম, এতে বেশিরভাগ ক্লাসমেটরাই বিরক্ত হতো। কখনো কখনো নিজের যুক্তি উপস্থাপন করে স্যারের সাথে গভীর আলোচনা জুড়ে দিতাম। এই কাজটাই আমার জন্য কাল হয়ে দাঁড়িয়েছিল। ক্লাসের অনেকেই আমাকে ব্যাঙ্গ বিদ্রুপ করতো৷ আমি গায়ে মাখতাম না৷ গ্রাম থেকে এসে হুট করে ভার্সিটির পরিবেশে ঠিক ততোটা মানিয়ে না নিতে পেরে ভুলভাল ইংলিশেই প্রশ্ন করে বসতাম। আমার পিছনে বসে ক্লাসমেটরা হাসাহাসি করতো।

আজ মিডের খাতা পেয়ে বেশ খারাপ লাগছে৷ সমস্যা হচ্ছে আমি সব বুঝতে পারি, সর্বোচ্চ মার্ক পাওয়া মেয়েটার থেকেও ভালোভাবে বুঝি, কিন্তু পরীক্ষার খাতায় ঠিক গুছিয়ে লিখতে পারি না৷ সেই কারণে এতো কম মার্কস পেয়েছি৷ ক্লাসে প্রশ্ন করে করে ক্লাসমেটদের বিরক্তির কারণ হওয়ায় অনেকেরই আগ্রহ ছিলো আমার মার্কস নিয়ে৷ তারা বেশ আমোদিত হলো আমার ৬.৫ পাওয়া নিয়ে৷ ক্লাস থেকে বের হওয়ার সময় সর্বোচ্চ মার্কস পাওয়া দু তিনজন আমাকে মিথ্যা সান্ত্বনা দিতে এলো৷ কেউ কেউ সেই মেকি সান্ত্বনা ছাপিয়ে আমার সামনেই হেসে দিলো৷

ক্লাস থেকে বের হয়ে শ্যাডোতে এসে সিগারেট ধরালাম। বুঝতে পারছিলাম না কি হচ্ছে আমার সাথে৷ আজ চারদিন ধরে প্রত্যাশার সাথে কথা হয় না৷ সেদিন বেশ ঝগড়া হলো। ঝগড়ার বিষয় খুবই তুচ্ছ৷ প্রত্যাশা বেশ কয়েকদিন ধরেই মুভি দেখতে চেয়েছিল। আমি এড়িয়ে যাচ্ছিলাম। হাতে টাকা ছিলো না। তাই এটা সেটা বলে, ব্যস্ততা দেখিয়ে এড়াতে চেয়েছিলাম। ঝগড়াঝাটির পর আমি ওর হলের সামনে গিয়ে দাঁড়িয়ে রইলাম দুই ঘন্টা৷ বারবার ফোন দিয়ে ওকে হলের সামনে আসতে বলেছিলাম। দু একবার ফোন রিসিভ করে প্রত্যাশা আর ফোন ধরে নি। হলের সামনেও আস নি। সেই থেকে আজ চারদিন ওর সাথে কথা হয় না। 

শ্যাডো থেকে হাটতে হাটতে কার্জনের দিক যেতে থাকলাম। মন খুবই বিক্ষিপ্ত ছিলো। পরীক্ষায় ভালো করতে পারি নাই, প্রত্যাশার সাথেও যোগাযোগ নেই। ভেবেছিলাম হয়তো ওর কাছে কিছুটা স্বস্তির নিঃশ্বাস ফেলতে পারব। দমবন্ধ লাগছিল। হাতে টাকা পয়সাও খুব বেশি নেই। একটা টিউশনি করি, সেই টাকাতেই চলতে হয় আমার। টিউশনিতে দিন গুনে টাকা দেয়৷ সপ্তাহে তিন দিন করে পড়িয়ে মাস শেষে ১২/১৩ দিন হলে টাকা দেয়ার কথা। কিন্তু তাদের সেই মাস শেষ হতো দুই আড়াই মাসে। স্টুডেন্ট পড়তে চাইতো না, তাই আমার ১২ দিন পূর্ণ হতো না, টাকাও পেতাম না। আজ দুই মাস বিশ দিন হয়ে গেলো, নয় দিন হয়েছে মাসের৷ মাস শেষ হতে আরো তিনদিন লাগবে৷ আজ পড়াতে যাওয়ার কথা ছিলো। স্টুডেন্টকে ফোন দিলাম। বললো পড়বে না আজ। 

মন ভয়ানক বিষিয়ে উঠতে লাগলো। কার্জনে ঢুকে আনমনে হাটতে লাগলাম। শহীদুল্লাহ হলের পুকুরপারের দিকে গিয়ে এক জায়গায় চোখ আটকে গেলো। প্রত্যাশার মত হুবহু দেখতে কাউকে দেখলাম এক ছেলের সঙ্গে বেশ অন্তরঙ্গভাবে বসা। হ্যা প্রত্যাশাই ছিলো মেয়েটা। ওর আকাশী নীল শাড়িটা চিনতে আমার ভুল হয় নি। ওকে ফোন দিলাম। প্রত্যাশা ব্যাগ থেকে ফোন বের করে দেখে নিয়ে আবার ব্যাগে ভরে রাখলো। 

আমার প্রচন্ড কান্না পাওয়া উচিত৷ অথচ আমার কান্না পাচ্ছে না। বুকের মধ্যে মস্ত বড় একটা পাথর চাপা অনুভূতি আটকে আছে। কান্না পেলে কষ্টের তীব্রতা কিছুটা কমে৷ অথচ ওরাও আমার সাথে প্রতারণা করছে৷ 

রুমে এসে দরজা জানালা বন্ধ করে দিলাম। জামা কাপড় টানানোর মোটা দড়িটা ফ্যানের সাথে পেচিয়ে গলার ফাঁস লাগালাম। তীব্র কষ্টে ছটফট করতে করতে অনুতাপ করতে লাগলাম। শেষ সময়ে বাঁচার জন্য আমার সেই নিঃশব্দ আকুতি কেউ শুনতে পায় নি। 

রাত দশটায় রুমের দরজা ভেঙে আমাকে উদ্ধার করা হলো। ইতিমধ্যে সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে আমার মৃত্যু নিয়ে বেশ আহাজারি চলছে। অবস্তুগত জগত থেকে আমি সব দেখতে পাচ্ছিলাম। আত্মহত্যা কোন সমাধান নয় বলে একদল মানুষ বেশ প্রচারণা চালাতে লাগলো। আমার বেশ কিছু শুভাকাঙ্ক্ষীও জুটে গেলো। ওরা আমার কতটা ভালো বন্ধু ছিলো সেটা প্রমাণ করে বিলাপ করতে লাগলো। ওদেরই দু তিনজন আমার আত্মহত্যা নিয়ে বেশ বড়সড় মোটিভেশনাল লেখা লিখে সবার সুনাম কুড়াচ্ছিল। অবস্তুগত জগত থেকে শব্দ করে হাসার নিয়ম নেই। তাই আমি হাসতে পারছিলাম না। 

প্রত্যাশা বেশ ভালো আছে৷ আমরা খুব ভালো বন্ধু ছিলাম এমনটা বলে ওর বান্ধবীদের কাছে কিছুক্ষণ দুঃখ প্রকাশ করে কার সাথে যেন দুই ঘন্টা ধরে ফোনে কথা বলছিল। 

পুলিশ আমার লাশের পাশে একটা চিরকুট পেলো। 

"I was at the edge of the cliff
ready to jump.
I looked to you,
hoping you'd try to stop me
You looked at me 
and sighed...
By the time you took 
a single step forward,
I was already 
plummeting towards 
the ground"