পোস্টস

গল্প

একটি খুন ও সম্পর্ক

৫ মে ২০২৪

S.M Kafi

মূল লেখক এস এম কাফি


রুমি আহমেদ বার বার নোটটা পড়ার চেষ্টা করছে। ডাক্তারি লেখার মতো কেউ এভাবে চিরকুট দেয় নাকি আশ্চর্য। মনে মনে তার সবচেয়ে প্রিয় গালি “শু**র বাচ্চা* কয়েকবার বলে ফেললেন। তার মন চাচ্ছে চিরকুট লেখক কে ধরে তার কান কেটে দিতে। 
রুমি আহমেদ হচ্ছে ফজল করিম আহমেদ এর একমাত্র স্ত্রী।  রুমি আহমেদ এর নাম ছিলো  রুমানা আশ্রয়ী ঘোষ। মুসলিম ছেলের সাথে বিয়ের পর স্বভাবতই নাম পালটে হয়েছে রুমি আহমেদ। স্বামীর কোটি কোটি টাকার প্রপার্টি থাকলেও স্বামীর মৃত্যুর পর এক আনা প্রপার্টি তার ভাগ্যে জোটেনি। এর প্রধান কারণ, একে তো সে হিন্দু ছিলো এবং  সংসার জীবনে তার কোনো সন্তান নেই। ফজল করিম আহমেদ এর ৩ ভাই সবকিছু হরিলুট করে যার যার কাজে ব্যাস্ত। বেচারা রুমি আহমেদ এর এখন থাকতে হয় নিজের জমানো টাকা দিয়ে করা ছোট্ট একটা বাড়িতে। আসলে জমানো টাকা বললে ভুল হবে। চুরি করা টাকা বললে বেশি ভালো শুনায়। ফজল আহমেদ ছিলেন বরাবর-ই হিসেবে কাঁচা এবং স্ত্রী ভক্ত লোক। তার পকেট কেটে রুমি আহমেদ ১-২ কোটি টাকা কিভাবে কিভাবে যেনো হাতিয়ে নেয়।  ভাগ্যিস এই কাজ সে করেছিলো নয়তো আজকে তাকে পথে বসতে হতো। 
রুমি আহমেদ এর বাসায় কুরিয়ারে একটা বই এসেছে আজ। বইয়ের প্রচ্ছদ দেখেই যে কারোর-ই বই কিনতে মন চাইবে। একটা অদ্ভুত রকমের মেয়ে আকাশী রঙের শাড়ি  পড়ে নাচার ভঙ্গিতে দাড়িতে আছে। হাতে গুটি কয়েক বকুল ফুলের তৈরি মালা। মেয়েটার ব্যাকগ্রাউন্ডে একপাশে নদী অন্য পাশে সমুদ্র।  বইয়ের নাম আবছা আবছা করে লিখা, আমি তোমাকে অদ্ভুত রকমের ভালোবাসি। 
এই ৪৯ বছর বয়সের এক আধ বয়স্ক মহিলাকে এমন অদ্ভুত বই কে পাঠাবে, ভেবে পাচ্ছে না রুমি আহমেদ।  বই খুলেই প্রথমেই চিরকুট টা পেলো রুমি। কিন্তু কোনো ভাবেই তা পড়তে পারছে না। মনে মনে গালাগালি করে পরের পৃষ্ঠায় গিয়ে দেখে ফাঁকা। পুরো বইটাই ফাঁকা আসলে। কোথাও কিছু লিখা নেই।  পিছনের দিকের একটা পাতা জুড়ে রক্তের মতো দাগ। শুকে কালো হয়ে গেছে।  রুমি আহমেদ ভাবলেন হয়তো কেউ ফাজলামো করছে তার সাথে। আরো কিছুক্ষণ,  যে পাঠিয়েছে তাকে ইচ্ছামত গালাগালি করে রুমি আহমেদ বাইরে বের হবার জন্য রেডি হতে শুরু করলেন।  
গুন গুন করে রবীন্দ্র সংগীত গাইছেন আর চুল আচড়াচ্ছেন রুমি আহমেদ। আজকে সে খুব খুশি।  ৩২ বছরের এক যুবকের সাথে প্রায় ৬ বছর হলো তার প্রেম ঘটিত সম্পর্ক। তার স্বামী ফজল আহমেদ  এতোদিন তাদের মধ্যে কাঁটা হয়ে বসে ছিলো। কিন্তু এখন আর সেই বাঁধা নেই।  ফজল আহমেদের  মৃত্যুর  ৩ বছর আগে থেকে তাদের সম্পর্ক গভীর হতে শুরু করে। তখন বুড়োকে ছেড়ে চলে আসে নি শুধুমাত্র প্রপার্টির জন্য।  কিন্তু আফসোস!  মৃত্যুর পরেও রুমি আহমেদ কোনো প্রপার্টি নিজের দখলে আনতে পারেন নি।
তিনি আজকে যাবেন সেই যুবকের সাথে ঘুরতে। এই জন্যেই রুমির  মনে আজকে এতো ফুর্তি।  তাকে পাঠানো সেই বইয়ের  প্রচ্ছদের মতো করে  সাজতে ইচ্ছে করলো তার। তার স্বামী ফজল আহমেদও আকাশী রঙ ভারী পছন্দ করতেন। আলমারি থেকে খুঁজে ফজল আহমেদ এর দেয়া আকাশী রঙের শাড়ি পড়লেন এবং বাইরের বকুল গাছ থেকে কয়েকটি বকুল ফুল তুলে নিয়ে মালার মতো বানিয়ে হাতে পড়লেন। বিয়ের কিছুদিন পরেই ফজল আহমেদ বকুল ফুলের একটা গাছ নিয়ে আসে। কিন্তু দুর্ভাগ্যবশত গাছটি লাগানোর সময় তার বাম হাতের একটি আঙ্গুলের নখ উঠে যায়। রক্তে একাকার অবস্থা। ফজল আহমেদ তাই এর নাম দেন রক্ত বকুল।
অনেক্ষণ ধরে রেস্টুরেন্টে সেই যুবকের জন্য  অপেক্ষা করেও কোনো লাভ হলো না রুমি আহমেদ এর। কলেও কোনো রেসপন্স পাচ্ছেন না তিনি। এক গাল রাগ আর অভিমান নিয়ে বাসার উদ্দ্যেশ্যে রৌনা দিলেন। তার বাসার পাশের বাসার সামনে মানুষের জটলা দেখতে পেলেন। মানুষজন ছুটোছুটি করছে, সাংবাদিকরা ক্যামেরা নিয়ে ক্লিক ক্লিক আওয়াজ করছে। এই ভীড়ের মাঝে রুমি আহমেদ এর হঠাৎ চোখ পড়লো তার সেই যুবক আহসান আবির কে।
আহসান আবির হলেন ডিবি অফিসারের এসিস্ট্যান্ট। রুমি আহমেদের খানিকটা আন্দাজ করতে পারছিলেন কি ঘটেছে। তিনি আশেপাশের মানুষের গুঞ্জন থেকে আরো নিশ্চিত হলেন যে তার বাসার এক্সাক্ট ডান পাশের বাসাটায় ডাকাতি হয়েছে রাতে। বাসায় এক তরূনী ছিলো তাকে রেপ করা হয়েছে এবং রেপ করার পর তাকে হত্যা করা  হয়েছে। 
রুমি আহমেদ কিছুটা ভয় পেলেন, তিনিও বাসায় একা থাকেন।  এমন ঘটনা তার সাথেও হতে পারতো। খুব জোড় বেঁচে গেছেন তিনি। ডিবি এসিস্ট্যান্ট আবির এই ব্যাস্ততার মাঝেও রুমি আহমেদ এর সাথে কয়েক সেকেন্ডে ধরে চোখাচোখি করলেন এবং মিষ্টি হাসি দিয়ে বুঝিয়ে দিলেন এবার তুমি বাসায় যাও আমি তাড়াতাড়ি তোমার সাথে দেখা করব। রুমি আহমেদ কিছুটা অস্ফুট আনন্দ নিয়ে নিজের বাসায় ঢুকে গেলেন। রুমা বেশিক্ষণ শাড়ি পড়ে থাকতে পারে না। শরীর চুলকায়। সরাসরি বেডরুমে না গিয়ে ড্রয়িং রুমেই শাড়ি বদলাতে লাগনেন রুমি। হন হন করে ডিবি অফিসার মিস মাসুদা এবং তার এসিস্ট্যান্ট আবির রুমির বাড়িতে ঢুকে গেলো।  রুমি আতংকে তার দরজা আটকে ভূলে গেছে।  তারা দুজন সরাসরি ড্রয়িং রুমে নগ্ন রুমি আহমেদকে দেখতে পেলো । রুমি  দুইজনকে দেখে হতভম্ব হয়ে দৌড় দিলো বেডরুমের দিকে।   যদিও  আবিরের কাছে এই দৃশ্য

ছয় বছরের পুরোনো, অনিচ্ছা সত্ত্বেও আবিরকে এই দৃশ্য দেখতে বাধ্য করা হয় প্রতি সপ্তাহে , ডিবি অফিসার মাসুদা পরিস্থিতি সামাল দিতে ভিন্ন এক প্রসঙ্গ নিয়ে কথা তুললেন।  কয়েকমিনিট পর কিছুটা হাসি হাসি আর কিছুটা হতাশ মুখ নিয়ে ড্রয়িংরুমে আসলেন রুমি। আবির তার দিকে তাকিয়ে মিটিমিটি হাসছে। 
মিস মাসুদা কথা শুরু করলেন, আপনি নিশ্চয়ই জানেন আপনার পাশের বাসায়  একটা তরূনীকে হত্যা করে হয়েছে। আমি এই হত্যাকাণ্ড নিয়ে আপনার সাথে কথা বলতে এসেছি। রুমি আবার আবিরের দিকে তাকালেন, আবির ইশারায় আস্বস্ত করে দিলেন তাকে, চিন্তার কিছু নেই আমি আছি তো। 
মিস মাসুদা একের পর এক প্রশ্নের উপর প্রশ্ন করে যাচ্ছেন রুমি আহমেদ কে। রুমিও উত্তর দিচ্ছেন। কথার এক পর্যায়ে রুমি বইটার কথা বললেন মিস মাসুদাকে। কুরিয়ারে তার কাছে একটি বই এসেছে এবং বইটি সম্পুর্ন ফাঁকা। গুগলে বইয়ের নাম লিখে সার্চ দিয়েও কিছু পাওয়া যায়নি। এবং বইয়ের শেষের দিকে রক্তের মতো কিছু দাগ লেগে আছে। ইন্টারেস্টিং এই বইটা ছাড়া আর কোনো তথ্য খুঁজে পেলেন না মিস মাসুদা। বইটি একটি র‍্যাপিং পেপারে করে সাথে নিয়ে গেলেন ডিবি অফিসার মিস মাসুদা। বের হতে হতে আবির কে বললেন, “আপনার সাথে এই মহিলার সাক্ষাত কতদিনের। যেভাবে আপনারা দুজন চোখাচোখি করছিলেন দেখে মনে হচ্ছিলো কিশোর বয়সে প্রেমে ধরা খেয়েছেন আর আমি আসছি বিচার করতে। যাক বাদ দিন। এই বইটা ফরেন্সি ল্যাবে পাঠিয়ে দিন। ” 
রুমি আহমেদ এর বাসায় আজকেও একটি কবিতার বই এসেছে। সুনীল গঙ্গোপাধ্যায়ের একটি কবিতার বই। একদম স্বাভাবিকভাবে কেউ প্যাকেট করে কুরিয়ারে পাঠিয়ে দিয়েছে। এতে আগেরটার মতো কোনো রক্তের ছাপ বা এমন অদ্ভুত কিছু চোখে পড়েনি। 
আবিরের সাথে  ফেসবুকে পরিচয় তার।  এরপর আস্তে আস্তে প্রেম ঘটিত সম্পর্কে জড়িয়ে পড়েন তারা। আবির আগে একটি বিয়ে করলেও  তার স্ত্রী মারা যায় বিয়ের কিছুদিনের মধ্যেই। এরপর আর বিয়ের স্বাদ নেন নি তিনি। মধ্য বয়স্কা এক মহিলার সাথে পরোকিয়ায় জড়িয়ে পড়েন তিনি। আসলে প্রেম ট্রেম এসব কিছু না। আবিরের মেইন টার্গেট ছিলো রুমি আহমেদের স্বামীর সম্পত্তির উপর। রুমি আহমেদকে কোনোভাবে বাগিয়ে নিয়ে সব হাতিয়ে নিবে এই পরিকল্পনাই তার। কিন্তু রুমি আহমেদ যে ফজল আহমেদ এর কোনো সম্পত্তি-ই পাচ্ছেন না সেইটা এখনো জানে না আবির।  আর এই লোভে এখনো এই বুড়ির যত শারীরিক ও মানসিক ক্ষুধা আছে সব মিটাচ্ছেন আবির।
মিস মাসুদা কেসটার কোনো কুল কিণারা খুঁজে পাচ্ছেন না। তিনি ডিবিতে জয়েন করেছেন ছয়মাস হলো।  এতোদিন ছিছকে চুরি ডাকাতির কেস সামলিয়ে গেলেও এইবার হাতে পেয়েছেন ধর্ষণ সাথে হত্যাস কেস। বেশ বেগ পেতে হচ্ছে তাকে।  আবির কে বললেন ফরেন্সি রিপোর্ট যেনো তাকে বুঝিয়ে দেয়।
আবির ফাইল নিয়ে হাজির অফিসে। অফিসে  আর পাঁচ দশটা কেসের মতোই বলতে শুরু করেন আবির। কোথায় কোথায় আঘাত আছে, কিভাবে মারা হয়েছে, ক্ষত কত গভির এসবই একেক পর এক বলে যাচ্ছে আবির।  মিসেস মাসুদা কথার মাঝে নখ দিয়ে বললেন, আমরা যে রুমি আহমেদ এর বাসা থেকে বইটা পেয়েছি সেটার রিপোর্ট কোথায়।
-স্যার! ওটা এখনো রেডি হয় নি। বইয়ে লেগে থাকা রক্ত অনেক পুরোনো এই জন্য কিছুটা সময় লাগছে। 
-আচ্ছা তুমি যাও এখান থেকে।
মিস মাসুদা ফরেন্সি ল্যাবে একটি টেক্সট পাঠিয়ে দিলেন, বইয়ের ব্লাড সম্পর্কে যদি কিছু জানা যায় তবে যেনো তার এসিস্ট্যান্ট আবিরের রক্তের সাথে ক্রসচেক করিয়ে নেয়া হয়।
রুমি আহমেদ এর বাসায় আবিরের  আনাগোনা হয় এইটা মিস মাসুদা প্রথমদিন ই টের পেয়েছিলেন এবং কথার ইঙ্গিতে আবিরকেও বুঝিয়ে দিয়েছেন। 
রুমি আহমেদ এর মনটা ভালো যাচ্ছে না। প্রধান কারণ কয়েকদিন আবিরের সাথে দেখা না হওয়ার সাথে আরেকটি কারণ  হলো, এই পৃথিবীতে রুমি আহমেদ যে সত্যিই একা এইটা হঠাৎ অনুধাবন করেছেন। একটা সন্তান থাকলেও তার এমন পরিস্থিতি হতো না। ফজল আহমেদ এর সাথে বিয়ের প্রথম বছরেই তার পেটে বাচ্চা আসে। কিন্তু  সিজারের সময় বাচ্চাটা অপরেশন টেবিলেই মারা যায়।  
এরপর অনেক চেষ্টা করেও কোনো বাচ্চার মুখ দেখতে পাননি তিনি। 

আবির বইয়ের রিপোর্ট টা পেয়ে মাথায় হাত দিয়ে বসে পড়লো। এঁকি! এইটা যে তার রক্ত। এই বইয়ে তার রক্ত কিভাবে গেলো। বইয়ের রক্তের ডিএনএ এর সাথে তার রক্তের ডিএনএ একেবারে ১০০% মিলে গেছে। আবির বুঝতে পেরে গেলো সে নিশ্চিত কোনো একটা জায়গায় ফেঁসে যাচ্ছে। এক বাসায় ডাকাতি সাথে খুন ও ধর্ষণ, পাশের বাসা থেকেই তার ব্লাড সহ বই উদ্ধার।  সে নিজেও বুঝতে পারছে না কিভাবে কি সামাল দিবে। ভয়ে ভয়ে মিস মাসুদার কাছে ফাইলটা এগিয়ে দিলেন মিস্টার আবির।
মাসুদা কান চুলকাচ্ছে আর ফাইলে রিপোর্ট দেখছে।  মিচকি একটা হাসি দিয়ে আবিরকে সরাসরি বললেন, 
-তো আবির সাহেব, আপনি মেয়েটার বাসায় ঢুকে ডাকাতি করবেন ভালো কথা, খুন ও ধর্ষণ করলেন কেনো? আপনার যে অর্থ লোভ সাংঘাতিক রকমের এইটা আমি একটু খোঁজ নিয়েই জানতে পারি।

আপনি ফজল আহমেদ এর সম্পত্তি পাবার আশায় তার বুড়ো স্ত্রীর সাথে সম্পর্ক করছেন এটা অনেক আগেই ধারণা করেছিলাম।
কিন্তু এটা বুঝতে পারছি না আপনি তার পাশের বাসায় স্বর্নাকে কেনো খুন করলেন? আমি খোঁজ নিয়ে দেখেছি স্বর্ণার সাথেও আপনার ৩ মাস হলো প্রেম। অস্বিকার করার কোনো সুযোগ আপনার নেই। সব প্রমাণ আপনার মোবাইলেই আছে।
আবির খুব কষ্টে কথাগুলো হজম করলো। ঘেমে একেবারে অস্থির সে। জবাব দেবার মতোও কোনো ভাষা খুঁজে পাচ্ছে না। নিজেকে কিভাবে বাঁচাবে এই উপায় ও খুঁজে পাচ্ছে না।
-স্যার,স্যার! আমতা আমতা করে আবির বললো, স্যার এতক্ষণ যা যা বললেন সবই সত্যি আসলে। আমার আসলেই টাকার প্রতি আলাদা একটা লোভ কাজ করে। আসলে এতিম খানায় বড় হয়েছি তো স্যার, এই জন্য টাকার জন্য লোভটা একটু বেশি। কিন্তু আল্লাহর কসম স্যার আমি স্বর্নাকে মারি নি।
আমি ওইদিন রাতে ওর বাসায় গিয়ে দেখি ও ঘুমাচ্ছে। আমি সরাসরি আলমারি থেকে যা যা দরকার সব সড়িয়ে বিদায় হয়ে যাই। ওর বাসার একটা চাবি আমার কাছে থাকতো, আমি প্রায়ই ওর বাসায় ওর সাথে সময় কাটাতে যেতাম স্যার। আলমারির তালা খোলাটা আমি স্যার ২ মাসের ট্রেনিং করে শিখেছি। বেশি একটা বেগ পেতে হয় নি। কিন্তু কসম স্যার ওরে আমি খুন করি নাই। আর স্যার ওরে আমি ধর্ষণ করতে যাব কোন দুঃখে। ওর সাথে আমি প্রায়ই সময় কাটাতাম। স্বার্না-ই আমাকে ফোন করে করে নিয়ে যেতো ওর বাসায়। 
মিস মাসুদার কপালে চিন্তার ভাজ খেয়াল করলেন  আবির।  মাসুদা টেবিলের ড্রয়ার থেকে একটা ইনজেকশন বের করে নিজেই পুশ করলেন নিজের গায়ে। ব্যাথায় দুই তিনবার গোঙানির মতো আওয়াজ করে ২ মিনিটের জন্য একে শব্দহীন হয়ে গেলেন তিনি।
আবির তার স্যার মিস মাসুদাকে এক দৃষ্টিতে দেখছেন। কিছু বুঝে উঠতে পারছেন না কেউ-ই। 
- স্যার এটা কিসের ইনজেকশন দিলেন এটা? ইনসুলিন নাকি স্যার? আমাকে বললেই হতো আমি দিয়ে দিতাম কষ্ট করে আপনাকে দিতে হতো না। 
পরিস্থিতি সামাল দেয়ার জন্য আবির স্বাভাবিক হওয়ার চেষ্টা চালাচ্ছে। মাসুদা তার কথা বিশ্বাস করেছে কিনা এটা এখনো নিশ্চিত হতে পারছে না। 
- যাই হোক! আপনার কথা যদি সত্যিই ধরে নেই তবে এই বইয়ে আপনার রক্তের ছাপ কিভাবে এলো? তার ওপর আবার যেদিন খুন হলো সেদিন-ই  কাকতালীয় ভাবে রুমির বাসায়? 
আবির নিজেও কিছু বুঝে উঠতে পারছে না। এই বই আবির জীবনে কোনোদিন চোখেও দেখে নি। আবির তার স্যারের থেকে অনুরোধ করে বইটি নিয়ে বাইরে বের হয়ে আসলেন।
আবির বইটি হাতে নিয়ে চললেন রুমি আহমেদ এর বাসায়।  স্বর্ণার সাথে যে তার কিছু ছিলো এইটা রুমি আহমেদ এখনো কিছু জানে না। 
রুমির বাসায় গিয়ে দেখে রুমি বাসায় নেই। এক বৃদ্ধা মহিলা ঘর মুছছেন। বৃদ্ধা মহিলাটি অনেক আগে থেকেই, রুমি আহমেদ এর বিয়ের আগে থেকেই ফজল আহমেদ এর বাসায় কাজ করতেন। এখন অবশ্য কাজ করার ক্ষমতা একেবারে-ই নেই। তারপর ও বিশ্বস্ত বলে ফজল আহমেদের মৃত্যুর পর ইনাকেও সাথে নিয়ে এসেছে তার বাড়িতে।
অনেকদিন ছুটিতে থাকার পর আজ বাসায় ফিরেছে জানালো বৃদ্ধা মহিলাটি। আবির তার হাতে থাকা বইটি সোফার সামনে রাখা টেবিলে রেখে ধপাস করে সোফায় বসে চোখ বন্ধ করে রইলেন। বৃদ্ধা মহিলাটি  টেবিল মুছতে গিয়ে বইটির দিকে নজর দিলেন। 
-এমা!এই বইটা কই পাইলেন স্যার? কত শখ কইরা বড় বাবু বইটা আনছিলেন রুমি ম্যাডামের যখন বাচ্চা হইলো তখন।
- কি বলছেন? ভালো করে দেখে বলুন তো আসল কাহিনি কি? সবটা খুলে বলুন আমাকে।
-ফজল বাবুর বই খুব পছন্দ ছিলো। মেলা বই পত্তর পড়তেন। রুমি ম্যাডামের একটা শখ আছিলো, যে ফজল বাবুর একটা নিজের বই বাইর হবো।  বাবুর বিয়ার কয়েক বছর বাদেই ম্যাডামের পেটে বাচ্ছা আহে। ম্যাডামরে যহন হাসপাতালে নিয়া যায় তহন বাবু তার বউরে সেরপ্রাইজ দেওন লাইগা একটা বই লিখা নিয়া যায়।  
-এরপর কি হলো? আর উনার বাচ্চাই বা কোথায়?
- বাবু  হাসপাতালে ম্যাডামের বেডে বইটা এক হাতে নিয়া অন্য হাত দিয়া তার পোলারে কোলে নেয়।  লগে লগে দেহা যায় তার পোলাডা আর নড়চড় করতাসে না। মানে মইরা যায় গা পোলাডা। এরপর আর বইডা ম্যাডামরে দেয় নাই। কই জানি ফালায়া রাখছিলো। কিন্তু আপনে এইডা পাইলেন কই?
আবির বৃদ্ধার কাহিনি শুনে কোনো আগামাথা কিছুই খুঁজে পাচ্ছে না। বইটা হাতে নিয়ে ভাবতে ভাবতে রুমি আহমেদ বাসায় এসে পৌছালেন। রুমি আবিরের পাশেই সোফায় বসে পড়লেন।
আবির তার এক হাত রুমির কাধে কিছুক্ষণ রেখে একটা কথাও না বলে বইটা হাতে নিয়ে চলে গেলেন। 
বৃদ্ধার মুখে শোনা সব কথা তার স্যার মিস মাসুদাকে খুলে বললেন।
মিস মাসুদা স্বাভাবিক ভোঙ্গিতে সব কথা শুনে জোড় করে যেনো অবাক হবার ভান করলেন। এটাই মনো হলো আবিরের।
-খুব ইন্টারেস্টিং তো বিষয়টা। আচ্ছা ঠিকাছে তুমি যাও। আমি দেখছি বিষয়টা। আর শুনুন রুমি আহমেদের বাচ্চা হওয়ার সময় কোন হসপিটালে এডমিট হয়েছিলেন ওই হসপিটালের এড্রেস টা টেক্সট করে দিবেন আমাকে। সেখানে একটু খোঁজ নেয়া দরকার।

তিনদিন পর ডিবি অফিসার  মিস মাসুদা রুমি আহমেদ কে কল করে ইমার্জেন্সি অফিসে আসতে বললেন। 
-কেমন আছেন রুমি আহমেদ?  যাই হোক আপনি এতোক্ষণ ভালো থাকলেও এখন আমার থেকে যা শুনবেন তা শুনে হয়তো আর ভালো থাকতে পারবেন না।
- কেনো কি হয়েছে বলুন তো?
- আগে এটা বলুন আমাকে, আপনার কি একটি বাচ্চা হয়েছিলো? এবং বাচ্চাটি মারা গিয়েছিলো?
- হ্যাঁ। কিন্তু সে তো অনেক আগের কথা। এতো আগের কথা এখানে কেনো তুলছেন?
- কত বছর আগের কাহিনি এটা আনুমানিক? 
- ৩০-৩৫ বছর তো হবেই।এক্সাক্ট মনে আসতেছে না আমার। 
রুমি আহমেদ, আপনি একটু চোখে মুখে পানি দিয়ে আসুন। আপনাকে আজকে খুবই  খুশির একটা সংবাদ দিব। যদিও সাথে সামান্য দুঃখের সংবাদ ও আছে।
- ভঙ্গিমা আমার পছন্দ না। আপনি যা বলবেন সরাসরি বলুন।
-আচ্ছা আচ্ছা শুনুন তাহলে।
মিস মাসুদা চেয়ার থেকে উঠে রুমের মধ্যে হালকা পায়চারি করতে শুরু করলেন।   আপনি কি এটা জানেন?  আপনার কাছে আসা কুরিয়ারে যে বইটি এসেছিলো সেখানে আমার এসিস্ট্যান্ট আবিরের রক্তের ডিএনএ পাওয়া গেছে। 
এরপর আবিরের থেকে শুনা বৃদ্ধার সেই বইয়ের কাহিনিটিও শুনিয়ে দিলেন রুমিকে। রুমি আপনি কিছু কি আঁচ করতে পারছেন?
রুমি এখনো কিছু বুঝে উঠতে পারছে না। আসলে কারো সাথে কারো কানেকশন খুঁজে পাচ্ছে না। 
-প্লিজ স্যার,আপনি আমাকে খোলাসা করে বলুন। আমি কিছু বুঝতে পারছি না।
আপনার বাচ্চা হওয়ার পর, আপনার বাচ্চা মারা যায় নি। ফজল আহমেদ এর তিন ভাই চক্রান্ত করে বাচ্চাটিকে অন্য কোথায় চালান করে দেয়। তার বদলে একটি মৃত বাচ্চা আপনাদের কোলে ধরিয়ে দেয়। এর কারণ বুঝতেই পারছেন। সম্পত্তি পাবার লোভে। আপনাদের কোনো ছেলে সন্তান হলে তারা তো আর ভাগ পাচ্ছে না এতে,তাই না? বাচ্চা চুরির ব্যাপারটা আমি গতকাল হাসপাতাল থেকে জেনে এসেছি।
ফজল আহমেদ এর হাত থেকে কোনোভাবে  আসল বাচ্চাটির রক্তের দাগ লেগে যায় বইটির গায়ে। এবং আমরা এই রক্তের সাথে আবিরের রক্তের ডিএনএ এ মিল পাই।
এর মানে হচ্ছে আবির আপনার সন্তান। যার সাথে আপনার ৬ বছরের  বেশি প্রেমের সম্পর্ক। 
রুমি আহমেদের মুখ থেকে আর একটি কথাও বের হলো না। দৌড়ে অফিস থেকে বের হয়ে নিজের বাসায় চলে গেলেন। 
পিছন থেকে অনেক ডাকাডাকি করেও কোনো সাড়া পেলেন না মিস মাসুদা। 
মিস মাসুদা একই ভাবে আবিরকে ডাকলেন। আবিরকে ডেকেও একই কথা খুলে বলতে লাগলেন তিনি। আবির আবার লক্ষ্য করলো মিস মাসুদা  কি যেনো ইনজেকশন নিচ্ছেন। 
আবির উনাকে হেল্প করার জন্য এগিয়ে গেলেন। ইনজেকশনটার নাম খেয়াল করলেন স্পিরোনোল্যাকটোন এন্টি টেস্টোস্টোরেন। ইনজেকশন দেয়ার সময় উনার বাম হাত খেয়াল করে দেখেন একটা আঙ্গুলে নখ নেই তার।
এইদিকে আর খেয়াল না করে মিস মাসুদার কথা শুনতে লাগলেন তিনি। 
আবিরের মাথাও ভন ভন করতে  লাগলো। এতোদিন তাহলে সে তার মায়ের সাথে ছি! এ কিভাবে হয়। শেষের কথাগুলো আবিরের কানে যেনো গলন্ত লোহা হয়ে ঢুকছে। আবির নিজের গায়ে দু বার চিমটি কাটলো এইটা নিশ্চিত হওয়ার জন্য, সে জেগে আছে। এইটা স্বপ্ন দেখছে না। জীবনে সে অনেক থ্রীলার গল্প উপন্যাস পড়েছে। সবকিছুই কেমন যেনো থমকে গেছে তার জীবনের থ্রীলের কাছে। 
নিজের শরীরকেই আবির ঘ্যেন্যা করতে শুরু করলো।
আবির সিদ্ধান্ত নিয়ে ফেলেছে, এই শরীর সে আর রাখবে না। ট্রেনে নিচে ফেলে এই শরীরকে ক্ষত বিক্ষত করে দিবে। কিন্তু শেষ বারের মতো সে তার মা কে দেখতে চায়। এক সেকেন্ড এর জন্য হলেও সে তার মা কে দেখবে।
আবির তার মাকে দেখার জন্য তার বাসায় ঢুকে যায় ডুপ্লিকেট চাবি দিয়ে। জীবন্ত মাকে সে আর দেখতে পায় না। সিলিং ফ্যানে ঝুলছে তার লাশ। তার মাও হয়তো শরীরে ঘ্যেন্যা সইতে না পেরে নিজেকে শেষ করে দিয়েছে। 
আবির বসে পরে ফ্লোরে। সবকিছু ঘুরপাক খেতে থাকে মাথায়। কেসটা এসেছিলো স্বর্ণার খুন নিয়ে। সেখানে কি হয়ে গেলো এইসব। মিস মাসুদারই বা এতো ইন্টারেস্ট কেনো তাদের প্রতি। আসল কেস রেখে তিনি কেনো আমাদের পিছে লেগেছে? 
আর উনি কেনোই বা জেন্ডার চেঞ্জ এর হরমোন নিচ্ছে? উনি আসলে কে?  আবিরের মাথায় জট পাকানো জিনিসগুলো আস্তে আস্তে আরো জট পাকাতে  শুরু করেছে মনে হচ্ছে। 
আবির মনে মনে তার শরীর ক্ষত বিক্ষত করার ডেট কিছুদিন পিছিয়ে দিলো। এবার তাকে কিছু একটা করতে হবে!