পোস্টস

প্রবন্ধ

আমেরিকা কেন সবসময় ইসরায়েলকে সমর্থন করে?

২ মে ২০২৪

সামদানী প্রত্যয়

মূল লেখক সামদানী প্রত্যয়

সমসাময়িক বিশ্ব রাজনীতির ব্যাপারে ন্যূনতম ধারণাও যাদের রয়েছে, তাদের যদি জিজ্ঞাসা করা হয় ইসরাইলের সবচেয়ে ঘনিষ্ট বন্ধু কে তাহলে এক কথায় সবার উত্তর হবে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র। হামাস ৭ অক্টোবর সকালে ইসরায়েলের ভূখণ্ডে  নজিরবিহীন এক হামলা চালায়। জবাবে ওই দিনই ফিলিস্তিনের গাজায় বিমান হামলা শুরু করে ইসরায়েল। গাজায় যতই মানবাধিকার লঙ্ঘিত হোক, যতই বেসামরিক মানুষের মৃত্যু হোক, যুক্তরাষ্ট্র দ্ব্যর্থহীন ভাষায় ইসরায়েলকে সমর্থন জানিয়ে যাচ্ছে। একই কথা তারা ঘুরেফিরে বলছে, ইসরায়েলের আত্মরক্ষার অধিকার রয়েছে। ইসরায়েলের এতটা বেপরোয়া কর্মকাণ্ডের পরও তাহলে কেন ইসরায়েলকে অটুট সমর্থন দিয়ে যাচ্ছে যুক্তরাষ্ট্র? এ সম্পর্কে জানতে হলে একটু পেছনে যেতে হবে।
 
 ইসরাইলের সৃষ্টি হয় ১৯৪৮ সালের ১৪ মে। সাবেক মার্কিন প্রেসিডেন্ট হ্যারি কে ট্রুম্যান, ১৯৪৮ সালে ইসরায়েল রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠার পর বিশ্বে প্রথম দেশ হিসেবে এই রাষ্ট্রকে স্বীকৃতি দেন। তিনি কেন প্রশ্নবিদ্ধ উপায়ে প্রতিষ্ঠিত রাষ্ট্রকে এত দ্রুত তড়িঘড়ি করে স্বীকৃতি দিলেন? এটি ছিল বিরাট এক প্রশ্ন। কিছুটা হচ্ছে ব্যক্তিগত সম্পর্ক। ট্রুম্যানের সাবেক ব্যবসায়ী অংশীদার এডওয়ার্ড জ্যাকবসন ইসরায়েল রাষ্ট্রের মার্কিন স্বীকৃতি আদায়ে বেশ গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখেন। ব্যক্তিগত সম্পর্কের বাইরে কৌশলগত বিষয়ও যুক্তরাষ্ট্রকে এই সিদ্ধান্ত নিতে আগ্রহী করে তুলেছে।

কিন্তু এরপরও যুক্তরাষ্ট্রের সাথে তাদের সুসম্পর্ক ছিল, তেমন নয়। প্রেসিডেন্ট আইজেনহাওয়ারের সময়ে ইসরায়েলের প্রতি আমেরিকার দৃষ্টিভঙ্গি  ছিল খুবই শত্রুভাবাপন্ন। বিশেষত ১৯৫৬ সালে যখন সুয়েজ যুদ্ধ হয়, যেখানে মিশরের বিপক্ষে লড়াই করে ইসরায়েল, যুক্তরাজ্য ও ফ্রান্স। ইজরায়েল মিশরের সিনাই উপদ্বীপ ও গাজার একটি অংশ দখল করলে যুক্তরাষ্ট্র তাদের দেওয়া আর্থিক সহায়তা বাতিল করার হুমকি দেয়। এরপর দীর্ঘদিন ইজরায়েলের বিভিন্ন কর্মকাণ্ডের বিরোধিতা করে এসেছে যুক্তরাষ্ট্র। 

কিন্তু ১৯৬৭ সালের পর যুক্তরাষ্ট্র ও ইজরায়েলের মধ্যকার সম্পর্ক দ্রুতগতিতে ঘনিষ্ঠ থেকে ঘনিষ্ঠতর হতে থাকে। 

১৯৬৭ সালের আরব-–ইসরায়েল যুদ্ধ হয়। সেই যুদ্ধে তুলনামূলকভাবে দুর্বল মিসর, সিরিয়া ও জর্ডানের সেনাবাহিনীকে পরাজিত করে ইসরায়েলি বাহিনী। এই যুদ্ধে ইহুদি রাষ্ট্রটি ফিলিস্তিনের বাকি ঐতিহাসিক জায়গা দখল করে নেয়। এর বাইরে সিরিয়া ও মিসরের কিছু অঞ্চল দখল করে। মধ্যপ্রাচ্য তেলসমৃদ্ধ অঞ্চল; রয়েছে সুয়েজ খালের মতো কৌশলগতভাবে গুরুত্বপূর্ণ জলপথ। এটাই বিশ্বশক্তিগুলোকে মধ্যপ্রাচ্যে নিজেদের আধিপত্য বিস্তারের লড়াইয়ে নামতে উৎসাহী করে তুলেছিল। এ ক্ষেত্রে যুক্তরাষ্ট্রের সুবিধা ছিল, তারা আগেই তুলনামূলক দুর্বল হয়ে পড়া ইউরোপীয় শক্তিকে নিজের পক্ষে টেনে আনতে পেরেছে। মধ্যপ্রাচ্যে মধ্যস্থতাকারী হিসেবে তাদের ভালোভাবেই কাজে লাগিয়েছে যুক্তরাষ্ট্র।

১৯৭৩ সালের আরব–ইসরায়েল যুদ্ধের কথা না বললেই নয়। সেই যুদ্ধে আবারও মিসর ও সিরিয়াকে শোচনীয়ভাবে পরাজিত করে ইসরায়েলি বাহিনী।

এই যুদ্ধে অবশ্য যুক্তরাষ্ট্রেরও কিছু ভূমিকা ছিল। তৎকালীন সোভিয়েত ইউনিয়ন যুদ্ধে মিসরকে অস্ত্র দিয়ে সহায়তা করতে চেয়েছিল। কিন্তু যুক্তরাষ্ট্রের বাধায় সেটা ব্যাহত হয়। যুদ্ধ শেষে যুক্তরাষ্ট্র ইসরায়েল ও মিসরের মধ্যে শান্তি প্রতিষ্ঠায় কাজ করে। তার সেই প্রচেষ্টা ১৯৭৯ সালে কিছুটা আলোর মুখ দেখে।১৯৭৩ সালে আরব-ইজরায়েল যুদ্ধের সময় মার্কিনীরা ইজরায়েলের পক্ষ নেয়। এই সিদ্ধান্ত দুই দেশের সম্পর্কের মজবুত ভিত্তি রচনা করে। তখন মার্কিন প্রেসিডেন্ট ও কূটনীতিকরা বুঝতে পেরেছিলেন যে, মধ্যপ্রাচ্যে সোভিয়েত ইউনিয়নের প্রভাব কমাতে ইজরায়েল তাদের কার্যকরী এক অস্ত্র হতে পারে। 

সোভিয়েত ইউনিয়নের সাথে স্নায়ুযুদ্ধের সময় থেকেই ইজরায়েল ও যুক্তরাষ্ট্র আরো ঘনিষ্ঠ হতে থাকে। 

এই যুদ্ধে মার্কিনরা বেশ সফলতাও অর্জন করে এবং নিজেদের বিশ্বের একমাত্র সুপারপাওয়ার হিসেবে প্রতিষ্ঠিত করতে সক্ষম হয়। যুক্তরাষ্ট্র বুঝতে পারে, মধ্যপ্রাচ্যে তাদের এমন একটি মিত্র দরকার, যারা তাদের প্রতিরূপ হিসেবে কাজ করবে। কারণ মধ্যপ্রাচ্যের সাথে যুক্তরাষ্ট্রের ভৌগোলিক দূরত্বের একটি বিষয় ছিল। সেই সমস্যা নিরসনে শক্ত ঘাঁটি বিনির্মাণের জন্যই তারা বেছে নেয় ইজরায়েলকে। 

যুক্তরাষ্ট্র তখন ইজরায়েলের সাথে ঘনিষ্ঠ সম্পর্ক তৈরির জন্য তাদের হয়ে ফিলিস্তিনের সাথে দেনদরবার করার দায়িত্ব গ্রহণ করে। একমাত্র যুক্তরাষ্ট্রের আশ্বাসের কারণেই এখনো ইজরায়েল যেকোনো শান্তি আলোচনার টেবিলে বসতে রাজি হয়। বিগত তিন মার্কিন প্রেসিডেন্টই চেষ্টা করেছেন ফিলিস্তিনের সাথে ইজরায়েলের একটি সুরাহা করার। তবে এক্ষেত্রে তাদের সমর্থনের পাল্লা তেলআবিবের দিকেই বেশি থেকেছে। 

যুক্তরাষ্ট্র সবসময়ই ইজরায়েলের অনেক অপরাধ দেখেও না দেখার ভান করে থেকেছে, যা অব্যাহত রয়েছে বর্তমানেও। ২০২৩ এ এসে গাজায় নৃশংস হামলার পরেও মার্কিন পররাষ্ট্রমন্ত্রী অ্যান্টনি ব্লিঙ্কেন, প্রতিরক্ষামন্ত্রী লয়েড অস্টিন ইসরায়েলের প্রতি সমর্থন জানাতে সেই দেশে ছুটে গেছেন। ব্লিঙ্কেন ইসরায়েলের স্বার্থরক্ষায় মধ্যপ্রাচ্যের বিভিন্ন দেশ সফর করেছেন।

এখন প্রশ্ন হচ্ছে, তখন কী এমন কৌশলগত বিষয় ছিল?

আসলে এই রাষ্ট্রের প্রতিষ্ঠা হয়েছে দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের ঠিক পরপরই। তখন যুক্তরাষ্ট্র আর তৎকালীন সোভিয়েত ইউনিয়নের মধ্যে স্নায়ুযুদ্ধের সূচনা হচ্ছিল।

তখন থেকে মধ্যপ্রাচ্যে যুক্তরাষ্ট্র দ্ব্যর্থহীনভাবে ইসরায়েলি সামরিক বাহিনীর শ্রেষ্ঠত্বের প্রতি সমর্থন জানিয়ে আসছে। তারা এই রাষ্ট্রটির প্রতি আরব বিশ্বের কোনো ধরনের মনোভাবকে তোয়াক্কা করে না।

যুক্তরাষ্ট্র ও ইজরায়েলের সম্পর্ককে বিশ্বের অন্যতম ব্যয়বহুল কূটনৈতিক সম্পর্কও বলা যায়। যুক্তরাষ্ট্রে প্রভাব সৃষ্টির জন্য ইজরায়েল যেমন প্রচুর অর্থ ব্যয় করে, তেমনি যুক্তরাষ্ট্রও তাদের বড় অঙ্কের আর্থিক সহায়তা দিয়ে থাকে। 
তবে এরপরও দুই দেশের মধ্যে একটি গুরুত্বপূর্ণ বাণিজ্যিক সম্পর্ক রয়েছে, যেখান থেকে লাভবান হচ্ছে যুক্তরাষ্ট্র। ১৯৮৫ সালে ইজরায়েলের সাথে মুক্ত বাণিজ্য চুক্তি করে যুক্তরাষ্ট্র। এরপর থেকে দুই দেশের মধ্যে বাণিজ্যের হার অনেক বেড়েছে। ইজরায়েলে থাকা মার্কিন দূতাবাসের তথ্যমতে, ২০১৬ সালে দুই দেশ প্রায় ৪৯ বিলিয়ন মার্কিন ডলারের ব্যবসা করেছে, যা থেকে সিংহভাগ লাভবান হয়েছে মার্কিন প্রতিষ্ঠানগুলো। এছাড়া যুক্তরাষ্ট্রে প্রায় ২৪ বিলিয়ন ডলার বিনিয়োগ করেছে ইজরায়েল।যুক্তরাষ্ট্রের জন্য ইজরায়েল বেশ গুরুত্বপূর্ণ একটি বাজার। 

দেশটির বিভিন্ন রাজ্য ইহুদিপ্রধান দেশটির সাথে বিভিন্ন ব্যবসা করে আসছে, যা থেকে সামগ্রিকভাবে মার্কিন অর্থনীতি লাভবান হচ্ছে। বলা হয়ে থেকে অর্থনৈতিক ও বাণিজ্যিকভাবে ইজরায়েল যুক্তরাষ্ট্রকে তার কল্পনার চেয়েও অনেক বেশি দিয়েছে। এর প্রতিদান অবশ্য যুক্তরাষ্ট্রও কম দিচ্ছে না! এছাড়াও আরো গভীরে গেলে দেখা যায় যে , আমেরিকার রাজনৈতিক ও আর্থসামাজিক ব্যবস্থাপনা নিয়ন্ত্রণ করে মূলত কর্পোরেট হাউজগুলো। তারা প্রেসিডেন্ট পর্যন্ত বানাতে পারে, সরাতে পারে। এসব কর্পোরেট হাউজগুলোর দিকে তাকালে দেখা যায় এদের মালিক কিংবা অধিকাংশ ক্ষেত্রেই কম্পানিগুলোর মূল দায়িত্বে থাকা প্রধান নির্বাহী কর্মকর্তা বা চীফ এক্সজিকিউটিভ অফিসার, সিইও হলেন জুইশ কমিউনিটির মানুষ। 

যুক্তরাষ্ট্র ও ইজরায়েলের ঘনিষ্ঠ সম্পর্কের পেছনে আমেরিকান ইজরায়েল পাবলিক অ্যাফেয়ার্স কমিটি (আইপ্যাক)-এর অবদানকে কেউ অস্বীকার করতে পারবে না। আইপ্যাক কোনো রাজনৈতিক সংগঠন নয়। কিন্তু এরপর তাদের যুক্তরাষ্ট্রের পররাষ্ট্র নীতি নির্ধারণের উপর বড় প্রভাব রয়েছে। মার্কিন সরকারের মধ্যপ্রাচ্য বিষয়ক বিভিন্ন সিদ্ধান্তে তাদের ইচ্ছার প্রতিফলন ঘটে থাকে।

কিন্তু তারা এই কাজ করে কীভাবে? 'কংগ্রেশনাল ক্লাব' নামে আইপ্যাকের বিশেষ একটি দল আছে। এই দলের প্রত্যেক সদস্য প্রতি নির্বাচনে সর্বনিম্ন পাঁচ হাজার ডলার চাঁদা দিতে প্রতিশ্রুতিবদ্ধ। আর এই অর্থ ইজরায়েলপন্থী রাজনীতিবিদদের নির্বাচনে ব্যয় করা হয়। পরবর্তীতের এদের মধ্যে যারা জয়লাভ করে, তাদের মাধ্যমে সিনেট এবং হাউজে প্রভাব বিস্তার করে নিজেদের নীতির বাস্তবায়ন করে। 

তবে আইপ্যাক সামগ্রিকভাবে কত অর্থ ব্যয় করে, সেই সম্পর্কে জানা যায় না। তবে তাদের এমন কিছু সদস্য আছে, যারা এক মিলিয়ন থেকে শত মিলিয়ন পর্যন্ত অর্থ সাহায্য দিয়ে থাকে। আর এই সকল দাতাদের ধ্যান-ধারণা সবই ইজরায়েলকে ঘিরে। তারা যেকোনো মূল্যে মধ্যপ্রাচ্যে ইজরায়েলকে টিকিয়ে রাখতে চান। 

শুধুমাত্র ট্রাম্পের শাসনামলেই আইপ্যাক অনেকগুলো সফলতা অর্জন করেছে। এর মধ্যে রয়েছে জেরুজালেমকে ইজরায়েলের রাজধানী ঘোষণা, ইরানের সাথে করা পরমাণু চুক্তি থেকে যুক্তরাষ্ট্রের বের হয়ে আসা এবং ফিলিস্তিনকে দেওয়া সাহায্য বন্ধ করা।

যুক্তরাষ্ট্রে এমন অনেক সংগঠন রয়েছে, যারা ইসরায়েলের প্রতি সমর্থন তৈরিতে কাজ করে থাকে। এর মধ্যে সবচেয়ে বড় এবং রাজনৈতিকভাবে সবচেয়ে প্রভাবশালী সংগঠন হচ্ছে আমেরিকান ইসরায়েল পাবলিক অ্যাফেয়ার্স কমিটি (এআইপিএসি)।
এই সংগঠনের সদস্যদের প্রভাব মার্কিন ইহুদিদের মধ্যে একেবারে তৃণমূলে রয়েছে। তারা যুক্তরাষ্ট্রে মার্কিন ইহুদিদের নানা পরামর্শ দিয়ে থাকে, তাদের কাছ থেকে তহবিল সংগ্রহ করে থাকে। শুধু ইহুদি নয়, কট্টরপন্থী খ্রিষ্টান ইভানজেলিক গির্জা থেকেও তারা তহবিল সংগ্রহ করে।

এআইপিএসি প্রতিবছর যুক্তরাষ্ট্রের রাজধানী ওয়াশিংটন ডিসিতে বার্ষিক সম্মেলন করে থাকে। এতে প্রায় ২০ হাজার প্রতিনিধি উপস্থিত থাকেন, যাঁদের মধ্যে মার্কিন রাজনীতির শীর্ষ পর্যায়ে রয়েছেন, এমন ব্যক্তিদেরও দেখা যায়। মার্কিন প্রেসিডেন্ট জো বাইডেন এবং সাবেক প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্প এই সম্মেলনে অংশ নিয়েছিলেন। ইসরায়েলি প্রধানমন্ত্রী বেনিয়ামিন নেতানিয়াহু নিয়মিত এই সম্মেলনে হাজির হয়ে থাকেন।

এখন কথা হচ্ছে, এআইপিএসির কোনো প্রতিদ্বন্দ্বী সংগঠন কি যুক্তরাষ্ট্রে আছে? তাদের মতো প্রভাবশালী না হলেও ইসরায়েলপন্থী জে স্ট্রিট নামে একটি ছোট সংগঠন রয়েছে। ডেমোক্র্যাটরা মূলত এই সংগঠন তৈরিতে ভূমিকা রেখেছেন। এঁদের লক্ষ্য, মার্কিন রাজনীতিতে একটি সমর্থক গোষ্ঠী তৈরি করা, যাঁরা ইসরায়েল ও ফিলিস্তিনিদের অধিকারের প্রতি সোচ্চার হবে।

ইসরায়েলপন্থী বিভিন্ন গ্রুপ মার্কিন রাজনীতিতে বিপুল পরিমাণ অর্থ দিয়ে থাকে। ২০২০ সালের প্রেসিডেন্ট নির্বাচনের প্রচারে ইসরায়েলপন্থী গ্রুপগুলো ৩ কোটি ৯ লাখ ৫০ হাজার ডলার তহবিল দিয়েছে, যার ৬৩ শতাংশ পেয়েছেন ডেমোক্র্যাটরা, ৩৬ শতাংশ পেয়েছেন রিপাবলিকানরা। ওপেন সিক্রেট ডট ওআরজি–এর তথ্যমতে, ২০১৬ সালের তুলনায় ওই বছর প্রায় দ্বিগুণ নির্বাচনী তহবিলের জোগান দিয়েছে ইসরায়েলপন্থী গ্রুপগুলো।

যুক্তরাষ্ট্রের রাজনীতিতে ইসরায়েলের প্রভাব কতটা, সেটা ওপরের লেখা থেকে কিছুটা হলেও আঁচ করা যাচ্ছে। এখন প্রশ্ন হচ্ছে, বর্তমান মার্কিন রাজনীতিকদের মধ্যে কার প্রতি ইসরায়েলের সমর্থন বেশি। যত দূর জানা যায়, সাবেক প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্পের প্রতি ইসরায়েলের অগাধ সমর্থন রয়েছে। তিনি ইসরায়েলকে সমর্থন করেন বলে ইভানজেলিক্যাল খ্রিষ্টানরা তাঁকে সমর্থন করেন। ইসরায়েলি প্রধানমন্ত্রী নেতানিয়াহুরও তাঁর প্রতি সমর্থন রয়েছে। চার বছরের ক্ষমতার মেয়াদে ট্রাম্প ইসরায়েলের ঘোর সমর্থক ছিলেন।
মার্কিন কংগ্রেসে ডেমোক্রেটিক ও রিপাবলিকান পার্টির বেশির ভাগ সদস্য প্রকাশ্যেই ইসরায়েলকে সমর্থন করে থাকেন।
প্রতিনিধি পরিষদের ডেমোক্র্যাট–দলীয় সাবেক স্পিকার ন্যান্সি পেলোসি, সদ্য সাবেক স্পিকার জন ম্যাকার্থি, সিনেটর চাক শুমার থেকে শুরু করে বেশির ভাগ সদস্যই ইসরায়েলের পক্ষে। এই নামের তালিকা করতে গেলে বোধ করি খুব কমই বাদ যাবেন। তাঁরা বর্তমান সংঘাতে ইসরায়েলের পক্ষে প্রকাশ্যে কথা বলছেন এবং হামাসকে নির্মূল করার পক্ষে জোরালো বক্তব্য দিচ্ছেন।

২০১৬ সালে সাবেক মার্কিন প্রেসিডেন্ট বারাক ওবামা ইসরায়েলের সঙ্গে ৩ হাজার ৮০০ কোটি ডলারের প্রতিরক্ষা চুক্তিতে সই করেন। ওই চুক্তির আওতায় পরবর্তী ১০ বছরে মার্কিন সামরিক সহায়তা পাবে ইসরায়েল। এর মধ্যে ক্ষেপণাস্ত্র প্রতিরক্ষাব্যবস্থা আয়রন ডোমের তহবিলও রয়েছে।

মনে রাখতে হবে, ইসরায়েলের আসলে সহায়তার খুব একটা দরকার হয় না। কারণ, অত্যাধুনিক প্রযুক্তি খাত থেকে এই দেশের বিপুল পরিমাণ আয় রয়েছে, যা ইসরায়েলকে উচ্চ আয়ের দেশে পরিণত করেছে। এর বাইরে যুক্তরাষ্ট্রের পররাষ্ট্রনীতি, জনমত, অর্থ ও রাজনীতিতে অর্থের প্রভাব এসব বিষয়ও ইসরায়েল ও ফিলিস্তিনের বিষয়ে মার্কিন নীতিতে বিরাট প্রভাব রাখে।

দীর্ঘদিন ধরে মার্কিন জনমত ইসরায়েলের পক্ষে এবং ফিলিস্তিনের বিপক্ষে। কারণটা হচ্ছে, ইসরায়েলের শক্তিশালী জনসংযোগব্যবস্থা রয়েছে। তবে এটাও ঠিক, ফিলিস্তিনপন্থীদের কিছু সহিংস কর্মকাণ্ড বিশ্ব গণমাধ্যমে শিরোনাম হয়েছে। যেমন ১৯৭২ সালে মিউনিখ অলিম্পিকে ১১ ইসরায়েলিকে হত্যা ইসরায়েলের প্রতি সহানুভূতি বাড়িয়ে দিয়েছে।

কিন্তু এটা কি সব সময় ইসরায়েলিদের পক্ষে যাচ্ছে? নাহ, তা–ও নয়। আগের চেয়ে এখন মার্কিনদের অনেকে ফিলিস্তিনিদের অধিকারের বিষয়ে সহানুভূতিশীল হচ্ছে। ২০২১ সালের ফেব্রুয়ারিতে পরিচালিত জরিপে দেখা গেছে, ২৫ শতাংশ মার্কিন ফিলিস্তিনিদের প্রতি সহানুভূতিশীল। ২০২০ সালের তুলনায় এই হার ২ শতাংশ এবং ২০১৮ সালের তুলনায় ৬ শতাংশ বেশি। ২০২১ সালে ফিলিস্তিনি কর্তৃপক্ষের প্রতি মার্কিন জনগণের সমর্থন ৩০ শতাংশে পৌঁছেছে। ২০২০ সালের তুলনায় তা ৭ শতাংশ বেশি।

তবে এখনো মার্কিন জনমত ইসরায়েলের প্রতি অনেক বেশি। একই জরিপে দেখা যায়, ৫৮ শতাংশ মার্কিন ইসরায়েলের প্রতি সহানুভূতিশীল।

তবে সম্প্রতি ফিলিস্তিন–ইসরায়েল যুদ্ধ নিয়ে প্রকাশিত এক জনমত জরিপে দেখা যায়, ৬৫ শতাংশ উত্তরদাতা মনে করেন, এই যুদ্ধে যুক্তরাষ্ট্রের উচিত প্রত্যক্ষভাবে ইসরায়েলকে সমর্থন করা। কিন্তু লক্ষণীয় হচ্ছে, ৪৫ বছরের কম বয়সী উত্তরদাতাদের মাত্র ৪৫ শতাংশ এমনটা মনে করেন।
 
কিন্তু মার্কিন নাগরিকরা কেন ইজরায়েলকে এত বেশি সমর্থন করে? সেটি হলো, ইজরায়েলে রয়েছে মধ্যপ্রাচ্যের একমাত্র গণতান্ত্রিক রাষ্ট্রব্যবস্থা। যুক্তরাষ্ট্রের খ্রিস্টান, ইহুদি ও উদারচিন্তার নাগরিকদের সম্মিলিত সমর্থন পাচ্ছে ইজরায়েল, যা তাদের মধ্যপ্রাচ্যে একটি শক্তিশালী রাষ্ট্রে পরিণত করেছে।
 
ইসরায়েলি হামলায় এভাবে সাধারণ ফিলিস্তিনি নিহত হওয়ার ঘটনা নতুন বিষয় নয়। তবে নতুন হচ্ছে আমেরিকায় এর বিরুদ্ধে প্রতিক্রিয়ার উর্ধ্বমুখী পারদ। নিউ ইয়র্কের মতো শহরে গাজায় ফিলিস্তিনিদের উপর হামলার বিরুদ্ধে বিক্ষোভ হয়েছে। কংগ্রেসে কিছু আমেরিকান আইনপ্রণেতা ফিলিস্তিনের পক্ষে কথা বলেছেন। বার্নি স্যান্ডার্সের মতো রাজনীতিবিদ প্রকাশ্যে ইসরায়েলকে সামরিক সহায়তা বন্ধের দাবি জানিয়েছেন। ইসরায়েল-ফিলিস্তিন ইস্যুতে প্রেসিডেন্ট জো বাইডেন ভেতরে-বাইরে নানামুখী চাপের মুখে পড়েছেন, যা আগে সেভাবে চোখে পড়েনি। এন্টি-সেমিটিক তকমা পাওয়ার ভয়ে ফিলিস্তিনের পক্ষে আমেরিকায় কেউই তেমন উচ্চবাচ্য করত না। এখন অন্তত দুই-একজন সেই ভয় কাটিয়ে উঠতে সক্ষম হচ্ছেন। ইসরায়েলের অন্যায়ের বিরুদ্ধে এক-আধটু কথা বলা শুরু করছেন, এবং এটাই সম্ভবত ইসরায়েল-আমেরিকা সম্পর্কের আপাত অবনতির দিক।

তবে এ সংকটের মধ্যেও যেভাবে মার্কিনী আশীর্বাদ পেয়ে চলছে ইসরায়েল তাতে অবস্থার উন্নয়ন যে শুধুই ধোঁয়াশা তা আর বলার বাকি থাকেনা।