পোস্টস

গল্প

বোধ......

২৯ এপ্রিল ২০২৪

রাশেদ স্বপ্ন

মূল লেখক রাশেদ স্বপ্ন

বাসটি চলে গেলে ধুলোর মেঘ উড়ে যায় তার পিছুপিছু। হাওয়ার দোলায় ভাসতে ভাসতে ধূলিকণারা ফিরে আসে জমিনে। কালো ধোঁয়া ও পোড়া জ্বালানির তীব্র গন্ধ নাকে এসে ধাক্কা দিতেই অনভ্যস্ত পথচারী মহিলাটি উৎকট গন্ধে নাকটি কাপড় চাপা দিয়ে ঢেকে ফেলে। এইটুকুনি যখন বয়স ছিলো আমার, চারচাকার এই বিরাট যানটিকে প্রচন্ড ভয় পেতাম। ডিজেল-পেট্রোল পোড়া গন্ধে নাক মুখ উলটে বমি আসত আমারও। দূর হতে দূরান্তরের যাত্রা তখন আমার ছেলেমানুষ মনে যতখানি রোমাঞ্চের সৃষ্টি করত, ততখানিই ভয়ের সঞ্চার করে যেত।

গতিশীল সেই চারপাশ আবদ্ধ কাঠামোতে আমার দম বন্ধ হয়ে আসত। ক্রমশ কষ্ট হত নিঃশ্বাস নিতে । গণপরিবহনের পুরোনো দুর্গন্ধ তাড়িয়ে বেড়াত। কখনো তেল চিটচিটে ময়লা সিটের গন্ধ, কখনো ডিজেল পেট্রোলের গন্ধ, কখনো ঘর্মাক্ত-অপরিচিত শরীর থেকে ভেসে আসা নোনা গন্ধেরা আমাকে এক মুহূর্তের জন্যেও আমাকে স্বস্তি দিত না। আমার মা যতদিন বেঁচেছিলেন, বমি পেলেই নাকের সামনে একটা পলিথিনের ব্যাগ ধরতেন। নীল রঙের সস্তা পলিব্যাগের উদ্ভট গন্ধে, বমি হত যতটা হওয়ার কথা তার থেকেও অনেক বেশি। মীরাও বমি করেছিল, একবারই। আমাকে জানিয়েছিল সে কথা। তারপরে ওর শরীরের ভেতর আরেক শরীরের অস্তিত্ব খুঁজে পাওয়া গেল। বলা বাঞ্ছনীয় এই যে, সেই পথের সাথী আমিই ছিলাম। অপরিণত তরুণ বয়সে পিতামাতা হওয়ার বিরল গৌরব তখন আমরা কেউই অনুভব করতে পারিনি। সেই জীবনে ততদূর অব্দি প্রাপ্ত সকল অনুভুতি ছাপিয়ে আমরা সেদিন অনুভব করেছিলাম ভয়। প্রচন্ড ভয় পেয়েছিলাম। যেই উদ্ভব হওয়া মিলনের আলিঙ্গন তীব্র আকাঙ্ক্ষার ছিল আমাদের কাছে, তাকেই সেদিন মনে হচ্ছিল অচ্ছুত কিছু, যাকে স্পর্শ করা মাত্র নষ্ট হয় যাবতীয় পবিত্রতা। সেসব আজ কতবছর হল, কে জানে। দেরি হয়ে গিয়েছিল অনেক। পৃথিবীর আলো দেখতে চাওয়ার আকুলতা নিয়ে যে প্রাণ বেড়ে উঠেছিল মীরার গর্ভে, সে প্রাণকে আমরা এই ধরণিতে সূর্যের সোনালি আলো কীভাবে নরম আদর বিছিয়ে যায় সবুজের ওপর তা দেখতে দিলাম না।

সময়ের স্রোতে ভেসে ভেসে বর্তমান যখন প্রতি মুহূর্তে ছুটে যাচ্ছে দূর হতে আরো দূরে, তখন পিছু ফিরে তাকালে দেখা যায় অতীতেরা কোথায় হারিয়ে গিয়েছে কালের অতলে। মীরা সেইভাবে হারিয়ে গেলো একদিন। কলঙ্ক হতে বাঁচবার যে মরিয়া প্রচেষ্টা আমরা করেছিলাম, তার ফলাফল ভোগ করল একমাত্র সে। জানতে পারল, ভবিষ্যতে তার মা হবার সম্ভাবনা নেই। অপরাধবোধ ও নিজের প্রতি এক তীব্র ঘৃণা পুষে রেখে মীরা চলে গেল। যুগপৎ জীবনের যে স্বপ্ন আমরা দেখেছিলাম, সেখানে যতিচ্ছেদ বসল। ওকে ফিরিয়ে আনার তীব্র আকাঙ্খা কোন অখন্ড অবসরের স্মৃতি রোমন্থনের সময় আমার ভেতরে জেগে উঠলেও বাস্তবিক সে প্রচেষ্টা আমি করিনি কখনো। এবরশনের পরে আমাদের স্বাভাবিক হতে অনেকটা সময় পার হয়ে গিয়েছিল। এরমধ্যে স্বাভাবিক হয়নি আমাদের সম্পর্কটাও। বিকর্ষণের সূত্র মেনে আমরা সরে গিয়েছিলাম দূর হতে আরো দূরে।
দূরত্ব বাড়তে বাড়তে একটা সময়ে আমাদের মাঝে কিলোমিটারের ব্যবধান বেড়ে অনেক হল। সময়ের ব্যবধান গিয়ে দাঁড়ালো বারো ঘন্টায়। কখনো কখনো আমি মীরার খোঁজ নিতে চাইতাম। ঝাপসা চোখে ‘কেমন আছো?’ ক্ষুদেবার্তা পাঠিয়ে বারো ঘন্টা পরে তার প্রতিউত্তর পেতাম, “ভাল আছি। তুমি মুভ অন করছো না কেন?”

মীরা জানত না আমিও ভালো ছিলাম। প্রাত্যহিক জীবনের ভীষণ ব্যস্ততায় আমি ওর কথা ভাবারই সুযোগ পেতাম না। শুধু মাঝে মাঝে কেমন আছে মীরা?-এই প্রশ্ন আমাকে অস্থির করে তুলত। ওর ভালো থাকার খবর আমাকে এক আশ্চর্য প্রশান্তি দিত। ভাবতাম, হোক আমাকে ছাড়া, ভাল আছে, তাতে ক্ষতি কী? আরো কয়েকমাস পরে কেমন আছো-ভালো আছি-র পর্ব শেষ করে আমার অন্তর্জাল উপস্থিতি মীরার ব্লক লিস্টে চলে গেলে আমি আর কখনো ওর খোঁজ নেইনি। তবু যাপিত জীবনে এই সকল যাবতীয় আটপৌড়ে ঘটনাবলীর ক্ষুদ্রাতিক্ষুদ্র অংশ হুটহাট আমাকে সেই মানুষটির কথা মনে করিয়ে দেয়।

বাসের চাকায় সৃষ্ট কৃত্রিম ধূলিঝড়টি থেমে গেলে আমি পথ চলতে শুরু করি। বিকেলের রোদ পড়ে এসেছে। নির্দিষ্ট গন্তব্যের বাসটি দেখা মাত্র পদচালনা দ্রুততর হয়। কাছাকাছি আসতেই হ্যান্ডেল ধরে শরীরটাকে টেনে তুলি পাদানিতে। প্রত্যাশিত যাত্রীদের ভিড় অপ্রত্যাশিতভাবে অনুপস্থিত দেখে স্বস্তি অনুভূত হয়। জানালার পাশের সিটটিতে বসামাত্র বিকেলের পড়ন্ত সূর্যের নরম সোনালী আলো চোখেমুখে এসে পড়লে আমার আবারো মনে পড়ে, পৃথিবীর আলো দেখতে চাওয়ার আকুলতা নিয়ে যে প্রাণ বেড়ে উঠেছিল মীরার গর্ভে, সে প্রাণকে আমরা এই ধরণিতে সূর্যের সোনালি আলো কীভাবে নরম আদর বিছিয়ে যায় সবুজের ওপর তা দেখতে দেইনি।
একুয়াস্টিকের সুরে ‘নভেম্বর রেইন’ বাজতেই পকেটে মৃদু কম্পন অনুভব করি। ফোন বাজছে। স্ক্রীনে ভেসে ওঠা নামটি চোখে পড়ে। স্ত্রী ফোন করেছে। অপসৃয়মান স্মৃতিদের আরো দূরে সরে যেতে দিয়ে আমি বাস্তবে ফিরে আসি। নেটওয়ার্কের অন্যপাশ থেকে স্ত্রীর কন্ঠ শুনতে পাই,
-কোথায় আছো এখন?
-বাসে উঠলাম মাত্র। আসতে যতক্ষণ লাগে। রাস্তার অবস্থা তো জানোই।
-ঠিক আছে। আসার সময় তেল, চিনি আর ডাল নিয়ে আসবে। আর সোহানা আপার বুটিক থেকে একটু ঘুরে এসো। মেয়ের জন্য জামা বানাতে দিয়েছিলাম। আজকে দেয়ার কথা। 
-ঠিক আছে।

ফোন রেখে দিয়ে বাইরে তাকাই। জনমানুষের ব্যাস্ততা ও দ্রুততা নজরে পড়ে। নিত্যদিনকার এই বাজারের ফর্দ বিনিময়ই বোধহয় ‘সংসারজীবনের একমাত্র পরিণতি’ বলে মনে হয় আমার কাছে। যদিও হানিমুন পিরিয়ডে যে আমি এবং আমার স্ত্রী খুব বেশি প্রেমময় সময় পার করেছি তেমনটিও নয়। বিয়েটা হয়েছিল পারিবারিক আয়োজনের ভিত্তিতে। আব্বার লতায়পাতায় সম্পর্কের এক আত্মীয় খোঁজ নিয়ে এসেছিলেন। ততদিনে বয়স যাচ্ছে বেড়ে। পৃথিবীর অপরপৃষ্ঠে বিচরণরত মীরার কোন খোঁজও আমার কাছে নেই। অন্যদিকে পিতৃদেব বৃদ্ধ হচ্ছিলেন। সবমিলিয়ে জৈবিক কিংবা মানসিক তাড়নার থেকে বহুগুণ জোরালো ছিল প্রয়োজনীয়তার তাগিদ। অতএব বিয়েটা হল। হল বটে, তবে কাগজ-কলমের সই সাবুদ কিংবা মৌখিক কবুল আমাদের মধ্যকার বরফ ভাঙতে কোনরকম সহযোগীতা করেনি। কোন কোন রাতে লঘু তারল্যের মাঝে আমি ওকে কাছে টেনে নিলে সে তাতেও বাধা দেয়নি। এভাবে প্রথমে এক মেয়ে, তারপর দুটি ছেলের জন্ম হলে আমরা দুজন থেকে পাঁচজন হলাম। নিজেদের ব্যক্তিগত সময়ের প্রয়োজনীয়তাটুকু অনুভব করার আগেই দায়িত্বের পাহাড়সমান চাপে সেসব মাথায়ই আসলো না। রোজকার জীবনে ছেলে-মেয়েদের চাহিদা, নিজেদের চাহিদা ও বেঁচে থাকার প্রয়োজনীয় রসদ জোগানোর চিন্তায় ধীরে ধীরে মধ্য বয়সে এসে নিজেকে আজকাল ভারবাহী গাধার মত মনে হয়। মাঝরাতে ঘুম ভেঙে গেলে এগারতলার বারান্দায় দাঁড়িয়ে ঘুমন্ত শহর আর বিস্তীর্ণ আকাশ চোখে পরলে আমার মনে হয়, এই জীবন কি আমি চেয়েছিলাম?  বস্তুত সত্য এই যে, এই শেকড় গেঁড়ে বসা জীবন আমি কখনো চাইনি। কতদিন কতরাত বদ্ধ দেয়ালের ভেতরে শুয়ে শুয়ে, মাথার ওপরে থাকা সিলিংকে আমাদের মনে হত ক্যানভাস। সেখানে আমি আর মীরা স্বপ্ন দেখে গিয়েছি বাধাহীন, সীমাহীন ভাবে। সেসব মীরার মনে আছে কিনা আমি জানি না। তবে আল্পস হতে হিমালয় অব্দি যে স্বপ্ন আমি দেখেছিলাম প্রাক্তনের সাথে, সেইসব কখনোই আমার মন থেকে মুছে যায়নি। জীবনের এই অপূর্ণতাটুকু আমার ভেতরে এক বোধের জন্ম দেয়। সংসার জীবনকে তীব্র ক্লান্তিকর ঠেকে। মনে হয়, আর কতদিন?

পিতা হিসেবে আমি কেমন, সে প্রশ্নের উত্তর আমার জানা নেই। দাম্পত্য জীবনের ক্রমবর্ধমান দূরত্ব ও পেশাগত জীবনের ব্যর্থতায় অর্থোপার্জনের ব্যস্ততা আমাকে সংসারের নিকটবর্তী হতে দেয়নি কোনদিন। অতএব এক কন্যা ও দুই পুত্র সন্তানের জনক হওয়া সত্ত্বেও সত্যিকার বাবা হতে কেমন লাগে আমি জানি না। সত্যি বলতে নিজের পুরোনো পাপের প্রায়শ্চিত্ত হিসেবে আমি কখনো বাবা হতেই চাইনি। কিন্তু আমার স্ত্রী সুরাইয়া, সেইসব বসন্তের রাতে যখন আমরা মিলিত হতাম জৈবিক তাড়নায়, আমাকে বারবার অনুরোধ করত একটি সন্তানের জন্য। হয়ত আগেই বুঝে গিয়েছিল আমাদের সম্পর্কটি এমনই থাকবে আজীবন। নিস্তরঙ্গ ঢেউয়ের মতন যে সম্পর্ক ক্রমশ বহমান, তাতে বসবাস করার ইচ্ছা সুরাইয়ার ছিল না। অতএব বাচ্চাদের নিয়ে ওর আলাদা জগৎ তৈরি হয়ে গেলে সেখানে আমার কোন স্থান কখনো ছিল কিনা, তা এক বিরাট প্রশ্ন। ওদের চারজনের সেই জীবনে আমি কোনদিন অনধিকার প্রবেশের চেষ্টাও করিনি। আমার সন্তানেরা তাই আমাকে ভয় পায়, দুরত্ব রেখে চলে সেটা আমি বুঝতে পারি। কিন্তু ওরা আমাকে ভালোবাসে কিনা তা জানি না। 

ঢাকার তীব্র যানজটকে উপেক্ষা করার উপায় নেই। মধ্যবিত্ত কিংবা নিম্ন-মধ্যবিত্ত জীবনের মতন খুঁড়িয়ে খুঁড়িয়ে চলা এই জ্যামকে ভালো লাগার কোন কারন আমি খুঁজে পাই না। ভ্যাপসা গরম ও কোলাহলের প্রাচুর্যে মনের শান্তি বিনষ্ট হয় প্রতিনিয়ত। সিট এবং ভাড়া বিষয়ক অভ্যন্তরীণ বচসা আমাকে কোন প্রকার আনন্দ দেয় না। আমি ফের বাইরে তাকাই। গায়ে গায়ে লেগে থাকা জন-পরিবহন, কালো ধোঁয়া, ক্রমাগত বেজে চলা হর্ন ও ব্যস্ত পথচারীদের উপেক্ষা করে আমার দৃষ্টি আটকে যায় ফুটপাতে। মীরা!

এত বছর বাদে ওকে দেখার পরেও আমার চিনতে ভুল হয়নি। কত দিন-মাস- বছর পরে আমি ওকে দেখতে পেলাম, তা এখন কাগজে কলমে না হলেও মস্তিষ্কের ভেতরে কিছু ছোটখাট হিসেব নিকেশে সীমাবদ্ধ। সেই ঝামেলায় যাওয়ার কোন বাসনা আমার মাঝে উপনীত হয়নি। যানজট ও বাড়িতে ফেরার তাড়া ভুলে গিয়ে আমি বাসের সিট ছেড়ে দ্রুত রাস্তায় নেমে পড়ি। ভিড়ের মাঝে ওকে এখনো দেখা যায়, পরিণত, মধ্যবয়ষ্কা মীরা, যার কিছু কিছু পেকে যাওয়া চুলের অস্তিত্ব দূর হতেও স্পষ্ট দেখা যাচ্ছে। ধীর পায়ে হেঁটে চলেছে সামনে। অন্যদিকে আমার দৃষ্টি কেবল মীরা হতে মীরাতেই আবদ্ধ হয়। আশপাশ দিয়ে মানুষের বিক্ষিপ্ত পথচলা আমাকে বিভ্রান্ত করতে পারেনা। ধীরে ধীরে আমাদের দূরত্ব কমে আসে। ওর পারফিউমের মিষ্টি গন্ধ অব্দি আমার ঘ্রাণেন্দ্রিয় পৌঁছে যায়। বহুদিন বহুকাল পরে আমি ওকে পিছুডাক দেই, জানতে চাই সেই পুরনো প্রশ্নের উত্তর, মীরা, কেমন আছো?  
মীরা সহজসিদ্ধ ভঙ্গিমায় ঘুরে তাকালো। যেন একটুও অবাক হয়নি, তেমনভাবে বলল, 
-ভালো আছি। তুমি?
ওর ঠোঁটের কোণে ভদ্রতার হাসি খেলে যায়। তারপর হঠাৎ আমাকে অবাক করে দিয়ে বলে,
-চা খাবে? চলো কোথাও বসি?
ওকে অনুসরণ করতে করতে আমার মনে হয়, আমি কি কখনো না করতে পারতাম?

মীরার বর্তমান আভিজাত্য আমাকে মুগ্ধ করে। চোখেমুখে বিত্তের ছাপ স্পষ্ট। আমি মনে মনে খুশি হই। কে যেন কানের পাশে ফিসফিস করে বলে ওঠে, মীরা ভাল আছে! মীরা ভাল আছে!  
দুটো কফির অর্ডার দিয়ে সে আমার দিকে ফিরল। বলল, 
-তারপর বলো, কী অবস্থা তোমার? কেমন আছো? 
-ভালো আছি। তুমি দেশে কবে এলে? 
-গত সপ্তাহে। হঠাৎ লম্বা ছুটি পেলাম। এক মাসের। ভাবলাম দেশে যাই। অতঃপর চলে আসা। তোমার সাথে দেখা হয়ে যাবে আশা করিনি। সারপ্রাইজ দিয়েছো একদম। 
-তোমাকে দেখে তো মনে হয়েছে তুমি জানতে আমাদের দেখা হবে। এটাও জানতে যে আমি তোমাকে জিজ্ঞেস করব, কেমন আছো?
মীরা হাসলো। বলল, “মনের সব অভিব্যক্তিই কি মুখে প্রকাশ পায়?” 

আমি লক্ষ্য করলাম এই পঞ্চাশ বছর বয়সে এসেও হাসলে মীরাকে অবিকল তরুণী বয়সের মতই সুন্দর লাগে। বহুবছর আগে যখন আমি ওকে বলতাম, আজ তোমাকে সুন্দর লাগছে, মীরা হেসেই সে কথা উড়িয়ে দিত। বলত, “প্রেমের চোখে সবই সুন্দর লাগে। তোমার এখন সেই প্রেমরোগ হয়েছে। অসুখের ঘোরে হ্যালুসিনেশন থেকে তোমার মনে হচ্ছে আমাকে আজ বেশ লাগছে!” প্রেমময় সেই মুহূর্তে তর্ক করার কোন ইচ্ছা আমার ছিল না। আমি বিনা বাক্যব্যয়ে মেনে নিতাম সে কথা। তবে এতদিন পরে আজও সে আমার চোখে যে সৌন্দর্য নিয়ে ধরা দিচ্ছে, তা আমি কোন চোখে দেখছি জানি না। মনের ভেতরে প্রশ্ন জাগে, ভালোবাসার চোখ কি এতটা দীর্ঘ সময় ধরে বেঁচে থাকে?  
 
মীরা আমার খবর জানতে চাইল। ওকে জানালাম বিয়ে করেছি, তিন সন্তানের বাবা হয়েছি, তারাও এখন দ্রুত বড় হচ্ছে। মেয়েটা গতবছরই বিশ্ববিদ্যালয়ে পা রেখেছে। তবে জীবনে অর্থনৈতিক সাবলম্বীতা যতটুকু আসবে আশা করেছিলাম, তা আসেনি। এইরকম সবমিলিয়ে ভালো-খারাপভাবে প্রতিনিয়ত বেঁচে আছি। মীরাকে আমি আমার সকল অপূর্ণতার কথা বলি না। ততটুকুই বলি যা সমাজ ও মানুষ জানে। বলি না যে, আমি জানি না আমার স্ত্রী-সন্তানরা আমাকে ভালোবাসে কি না। এই না বলতে পারার দহন আমাকে ভেতরে ভেতরে পোড়াতে থাকে। আমার মনে হয়, সমাজের সামনে ভালো থাকার যে নিদারুণ অভিনয় করে যাচ্ছি বহুদিন ধরে, আজ এত বছর পরে নিজের সবচেয়ে কাছের পুরোনো বন্ধুটির সাথেও আমি তাই করছি। আমি ওকে আমার ভালো থাকার গল্প বলতে বলতে ভাবি, সময় কতটা পুরু দেয়াল তৈরি করে দিলে এক সময়কার চির পরিচিত মানুষ, চির পরিচিত শরীর এতটা অচেনা হয়ে যায়?

মীরার কাছে আমার অনেক অনেক প্রশ্ন ছিল। কিছু কিছুর উত্তর পেলাম, কিছুর পেলাম না। কথায় কথায় জানতে পারলাম বিয়ে থা করেনি। টেক্সাসে থাকে এখন। ওখানেই চাকরি। এক জাপানিজ ভদ্রলোকের সাথে লিভ টুগেদার করছে। আমি অবাক হলাম, “এই বয়সেও?” “কী করব বলো?” ছোট একটা দীর্ঘশ্বাস ছেড়ে দিয়ে বলল সে। কিছুটা সময় কাঁচের দেয়ালের ওপাশে ব্যস্ত শহরের দিকে আনমনে তাকিয়ে থেকে তারপর কফির কাপে চুমুক দিয়ে বলল, “বিয়ে-শাদী আমার কাছে যন্ত্রণা মনে হয়। সন্তান হবে না কিছু না, কে বিয়ে করবে? সন্তানের লোভ কার হয় না, বলতে পারো? আফটার অল জীবনের উদ্দেশ্যই তো এই- নিজের ছাপটুকু রেখে যাও। পৃথিবীতে দিয়ে যাও ভবিষ্যতের জীবন। অনেক খুঁজেছি আমি শাওন। কেউ রাজি হয়নি সন্তান বিনা আমার সাথে বিয়ের চুক্তিতে আসতে।” 

আমি চোখ তুলে তাকাই ওর দিকে। দেখতে পাই মীরার দুইচোখে বিষাদ খেলা করে। ওর শ্যামবর্ণ মুখে চোখের নিচে কালচে নীল কাজলকে আমার কাছে বুঝি সেই বিষাদের বিষাদ-সিন্ধু বলে মনে হয়। আমি সেদিকে দীর্ঘক্ষণ তাকিয়ে থাকতে পারি না। লজ্জা হয়, ঘৃণা হয় নিজের প্রতি। এবারে কেউ কানের কাছে বিকট জোরে বলে ওঠে, মীরা ভালো নেই! মীরা ভালো নেই! 
অকস্মাৎ আমি এক আজব কান্ড করে বসি। চেয়ার ছেড়ে ওর পায়ের কাছে বসে পড়ে বলি, “আমাকে ক্ষমা করে দাও মীরা।“ ঝাঁ চকচকে আলিশান কফি হাউজে এই দৃশ্য অস্বাভাবিক। আগত অতিথি, ক্যাশিয়ার, ম্যানেজার, ওয়েটার সকলের অবাক দৃষ্টি উপেক্ষা করে আমি বলতে থাকি, “আমাকে ক্ষমা করো মীরা। মাফ করে দাও আমাকে।” আমার এহেন আকস্মিক কর্মকান্ডে মীরা হতবাক হয়ে যায়। তবে সামলে নেয় দ্রুতই। ম্যানেজারের সাথে চোখাচোখি হতেই কিছু একটা ইশারা করে আমাকে টেনে আবার টেবিলে বসায় ও। বলতে থাকে, “তুমি কি পাগল? ছিঃ কীসব করছো? এভাবে কেউ কারো পা ধরে?” ইশারা মোতাবেক ওয়েটার পানি নিয়ে আসে। মীরা বলে, “পানি খাও।”

কফিশপ থেকে বেড়িয়ে ফুটপাতে হাঁটতে হাঁটতে আমি মনের ভেতর জমানো কথাগুলো গুছিয়ে নেই। আমরা দুজনেই এখন চুপচাপ। আমি ওর পা ধরে ক্ষমা চাইবার পর আমাকে পানি খেতে বলাই এখন অব্দি ওর বলা শেষ কথা।  তারপরে একসময় নিজেই বলতে শুরু করল, “আমি কিন্তু পুরোনো কথা ভেবে কিছু বলিনি শাওন। তোমার কথার সূত্র ধরেই কিছু কথা বলেছি। সত্যি বলতে তোমার প্রতি পুরোনো অভিমান পুষে রাখার জন্য এতগুলো বছর অনেক লম্বা একটা সময়। তখন আমাদের দুজনেরই বয়স কম, ভুল করে ফেলেছিলাম। সে ভুলের প্রায়শ্চিত্ত আজও করতে হচ্ছে। বিষয়টিকে স্বাভাবিকভাবে নাও।”
আমার মনে পড়ে অনেক অনেক বছর আগের সেই রাতের কথা। আমরা নিকটে থেকেও আরো নৈকট্য চাইছিলাম দুজনার। গাঢ় ভালোবাসায় মাখামাখি বেশ কিছু মুহূর্তের পরে যখন শরীরের সাথে শরীর মিশে ইঞ্চি পরিমাণ দূরত্বও আমাদের মাঝে ছিল না, ওর অজান্তে আমি এক বিরাট ভুল করে ফেলেছিলাম। মীরা আমাকে প্রচন্ড বিশ্বাস করত। ও টেরও পায়নি কামের তাড়নায় আমি ইচ্ছাকৃতভাবে কোনরকম সুরক্ষা ছাড়াই সে রাতে মিলিত হচ্ছিলাম ওর সাথে। আমার ওপর ওর ভরসা এতটাই ছিল, আমার সেই অপরাধের খবর সে আজও জানে না। তার ধারণা এটি একটি দুর্ঘটনা মাত্র।
আমি ওকে সত্যিটা বলতে সাহস পাই না। ভয় হয়। মনে হয় এত বছর ধরে আমার প্রতি একটু একটু করে নিভে যাওয়া ঘৃণার আগুন আবারো দাউদাউ করে ওর মনে জ্বলে উঠবে। এত বছর বাদে ওকে এই দুঃখটুকু দিতে ইচ্ছা হয় না। ঠিক সেই মুহূর্তে আমি অন্তরের মধ্যিখানে বিবেক নামক কারো অস্তিত্ব টের পাই। সে আমাকে অকস্মাৎ প্রশ্ন করে বসে, এভাবে আর কতদিন নিজের কাছে ছোট হয়ে থাকা? নিজেকে লুকোনো সত্যের থেকে? আমি কোন উত্তর ভেবে পাইনা। মীরার থেকে লুকিয়ে, স্ত্রীর থেকে লুকিয়ে, সন্তানদের থেকে লুকিয়ে বাঁচার যে আপ্রাণ প্রচেষ্টা আমি এতগুলো বছর ধরে করে যাচ্ছি, তার কোন মানে হয় না বলে আমার বিবেক আমাকে জানান দেয়। আমি ঠিক করি  আজ মীরাকে সত্যিটা বলে দেব। ওর চোখে আজীবন ঘৃণার পাত্র হিসেবে বেঁচে থাকাও এই বিবেকের যন্ত্রণার থেকে ভালো। এক নারীকে মাতৃত্বের স্বাদ থেকে আজীবনের জন্য বঞ্চিত করা কিংবা নিজের কৃত কর্মের দায় হিসেবে পৃথিবীতে চলে আসা একটি নতুন প্রাণকে বাঁচতে না দেয়া, কোন অপরাধটির ওজন ভারী তা আমি আর আলাদা করতে পারি না। আমার মুখ হতে অস্ফুটে বেরিয়ে আসে, “মীরা শোনো…”

সত্যিটা জানার পরে মীরা ক্ষনিক চুপ করে ছিল। সব বলেছিলাম আমি ওকে। সেই রাত হতে আজ অব্দি নিজের সাথে অভিনয় করে বেঁচে থাকার কথা… সবকিছু। চুপ করে শুনছিল ও সব। একটি বারের জন্যেও বাধা দেয়নি আমাকে কিছু বলতে। তারপর একসময় আমার বলা শেষ হলে নিরবতায় কিছু সময় পার হয়ে যায়। কোন কথা নেই, শব্দ নেই আমাদের মাঝে। । শুধু চারপাশে গাড়িঘোড়ার আওয়াজ পাওয়া যাচ্ছিলো। সামান্য কিছু মুহূর্ত কেটে গিয়েছিল সেই অবস্থায়। ততক্ষণ মীরা তাকিয়ে ছিলো আমার চোখের দিকে। ওর তীব্র অন্তর্দৃষ্টি আমার ভেতরের পুরোটা দেখে নিচ্ছিল বলে মনে হয় আমার কাছে। আমিও তাকিয়ে থাকতে পারিনি সেই চোখের দিকে। মাথা নিচু হয়ে এসেছিল আমার। একসময় মীরা বলল, “তবুও ভুলে যাও সব শাওন। যা ঘটে গেছে তা পরিবর্তনের সক্ষমতা আমাদের নেই। যা আছে, তা মেনে নেয়া ছাড়া আর কিছু নয়। ভালো হলো এত বছর পরে হলেও তুমি সত্যিটা আমাকে বলেছো। তোমাকে ধন্যবাদ। অনুভুতির নিয়ন্ত্রণ তুমি করতে পারোনি। সেখানে তোমার দায় যতটুকু ছিল, ততখানি দায় ছিল আমারো, দায় ছিল সমাজেরও। কেন আমরা এবর্শন করাতে বাধ্য হয়েছিলাম মনে পড়ে তোমার? কখনো মনে হয়নি সমাজ মেনে নিলে আমাদের সংসারটি হতে পারত? কত বড় হয়ে যেত আমাদের সন্তানটি? জানো তুমি?”

মীরার কথাগুলো আমাকে শান্তি দিতে পারেনা। কেবলই মনে হয়ে ভদ্রতার খাতিরে হোক, বা দীর্ঘদিনের পুরনো আবেগের বশবর্তী হয়ে হোক, যে কারণেই মীরা আমাকে কথাগুলো বলুক, ওগুলো ওর মনে কথা নয়। বরঞ্চ আমাকে সান্ত্বনা দেয়া কিংবা পুনর্মিলনীটি শান্তভাবে সমাপ্ত করাই ওর মূল উদ্দেশ্য ছিল। বলতেই হয় মীরা সফল। ওর সেই কথার পরে আমরা আর একটি কথাও বলিনি। শ্রান্ত পাখিদের মত নিজ নিজ নীড়ের পথ ধরেছিলাম দুজনেই। 

বাসায় ফিরতে রাত হল। স্ত্রীর জিজ্ঞাসু দৃষ্টির জবাবে বললাম, “এক পুরোনো বন্ধুর সাথে দেখা হয়েছিল রাস্তায়। কুশলাদি বিনিময় ও পুরো স্মৃতি রোমন্থন করতে গিয়ে সোহানা আপার বুটিকে যেতে দেরি হল। বন্ধ পেলাম। ফোন করেছিলাম, বলেছে আগামীকাল দেবে। কাল অফিস থেকে ফেরার পথে নিয়ে আসব।”

ত্রী কিছু না বলে চলে গেল রান্নাঘরে। হাতমুখ ধুয়ে বিছানায় শরীরটা একটু এলিয়ে দিতেই আমার আবার মীরার কথা মনে হয়। আমি ভাবি, এই অপরাধ বোধের কি শেষ আছে কোন? চিন্তার অলিগলি ধরে আমি হারিয়ে যেতে থাকি। মীরা ও সুরাইয়া নাম্নী দুই নারী এক বিস্ময়কর রূপ নিয়ে আমার সামনে উদ্ভাসিত হয়। এক নারীর কোল খালি করে আমি অন্য নারীকে দিয়েছি তিনটি সন্তান। সেই সন্তানদের কেউ আমাকে ভালোবাসেনি। ভালোবেসে বাবা বলে ডাকেনি। সেই দুই নারীও ভালোবাসতে পারেনি আমাকে। জীবনের খেরোখাতায় ভালোবাসাবিহীন আমার নিজেকে প্রচন্ড ব্যর্থ বলে মনে হয়। লজ্জা ও নিজের প্রতি ঘৃণায় আমি আবারো মানসিকভাবে কুঁকড়ে যেতে থাকি।
-চা নাও। 
স্ত্র্যীর ডাকে কল্পনার সুতো ছিঁড়ে যায়। আধশোয়া হয়ে চায়ের কাপ হাতে নেই। স্ত্রী পাশে বসতে বসতে বলল, “তোমার সাথে কিছু কথা ছিল।” 
-কী কথা?
-গতসপ্তাহে আমাকে হাজার দশেক টাকা দিয়েছিলে যে, সেটা আলমারিতে রাখা ছিল। আজকে শফিক ভাই এসেছিল টাকাটা নিতে। আমি সমস্ত আলমারি তন্ন তন্ন করে খুঁজেও সেই টাকার কোন খোজ পাইনি। 
আমি ধরমর করে উঠে বসে বলি, “কী বলো? টাকা কে চুরি করবে?”
-আমার মনে হয় রাজীব-সজীবের কেউ একজন করেছে। সামনের শুক্রবারে স্কুলের পিকনিক বলে ওরা টাকা চেয়েছিল আমার কাছে, দেইনি। তাই হয়ত এমন করেছে। তুমি এখনই কিছু বলো না। কাল মেয়েটার পরীক্ষা। 
-তাই বলে পুরো দশ হাজার টাকা? বাপের জন্মে কোনদিন শুনিনি স্কুলের পিকনিক করতে দশ হাজার টাকা লাগে।
-আহা, দশ হাজার তো চায়নি। চেয়েছিল পাঁচশ টাকা। অতটাকা একসাথে দেখে লোভ সামলাতে পারেনি হয়ত।
-ঠিক আছে। কাল দেখছি। তোলো আরেকটু আদর দিয়ে দিয়ে মাথায়। আজকে নিজের বাপের টাকা চুরি করছে, কাল অন্যের বাপের টাকায় হাত দেবে। 
রাগে গজগজ করতে করতে স্ত্রীকে কোন কথা বলবার সুযোগ না দিয়ে আমি শুয়ে পড়ি। পাওনাদারের প্রাপ্য দশটি হাজার টাকা ফের জোগাড় কীভাবে করব সেই চিন্তায় আমার আবারো পরিশ্রান্ত লাগে। জীবনে লক্ষাধিকবারের মত নিজেকে ভারবাহী গাধা মনে হয়।
স্ত্রী জিজ্ঞেস করল, “শুয়ে পড়লে কেন? খাবে না?”
আমি বাজখাই গলায় বললাম, “সে অবস্থা রেখেছো তোমরা?”

বরাবরের মত মাঝরাতে আমার ঘুম ভেঙে যায়। অভ্যাসবশত সিগারেট হাতে নিয়ে বারান্দায় যেতেই আমি এক আপ্রত্যাশিত দৃশ্যের সম্মুখীন হই। বড় মেয়েটি মাথা গুঁজে কাঁদছে। এই মধ্যরাতে আমার মত ওর মনে কী দুঃখ জেগে উঠেছে আমার বুঝে আসেনা। আমি ধীরে ধীরে কাছে যেতেই আমার উপস্থিতি টের পেয়ে সতর্ক হয়ে ওঠে। চোখ মুছে বলে, কিছু না বাবা। বলেই পালানোর মত করে চলে গেলো। গেল বটে, তবে নিজেকে লুকোতে পারল না পুরোপুরি। বারান্দার মেঝেতে পড়ে থাকা একতাড়া কাগজ হাতে নিয়ে লাইটারের আলোয় দেখলাম, একটা আলট্রাসনোগ্রাম রিপোর্ট, সাথে কিছু হরমোনাল টেস্টের রিপোর্টও আছে। একজায়গায় দেখতে পেলাম স্পষ্ট করে লেখা, এইট উইকস প্রেগন্যান্ট। 

আমার ভেতরের সর্বস্ব সত্তা যেন নড়েচড়ে ওঠে। স্পষ্ট বুঝতে পারি হারিয়ে যাওয়া টাকাগুলো কোথায় গিয়েছে। আমি দৌড়ে ভেতরে যাই। দ্রুত মেয়ের রুমে গিয়ে উপস্থিত হতে ও আমাকে দেখে অবাক হয়। তারপর ওর চোখে পড়ে আমার হাতে থাকা মেডিক্যাল রিপোর্টের কাগজগুলো। ওর ভয়ে সাদা হয়ে যাওয়া মুখটিকে দেখে আমার মনে হয় আমি মীরাকে দেখছি। বহু বছর আগে, মীরার মুখের অভিব্যক্তি এরকমটাই ছিলো। আমি ধীর পায়ে এগিয়ে ওর মাথায় হাত রাখি, বলি, বাবা আছে তো! কিচ্ছু হবে না।

এখন রাত্রির শেষাংশে আমরা বাবা-মেয়ে বসে আছি বারান্দায়। সামনে অনেক অনেক যুদ্ধ। লড়তে হবে সব কিছু। আমি মনে মনে ঠিক করি, মীরা কিংবা আমার মত একটি জীবন আমি আমার সন্তানকে ভোগ করতে দেব না। অপরাধবোধ হয়তো বিচারকের থেকে আমাদের মুক্তি দেয়, জীবন থেকে যে দেয় না, তা আমি এখন স্পষ্ট করে জানি। আমার প্রতিজ্ঞা প্রতি মুহূর্তে দৃঢ় হতে দৃঢ়তর হয়।  হঠাৎ মেয়ে আমার হাত চেপে ধরে বলল, “থ্যাংক ইউ বাবা।“ আমি অবাক চোখে ওর দিকে তাকাই। ফের মুখ খুলল, “তোমাকে ভালোবাসি বাবা।“

আমার দু চোখ থেকে গাল বেয়ে একটি সরু অশ্রুধারা গড়িয়ে পড়ে। ভোরের আলো এগিয়ে আসতে আসতে মিলিয়ে যেতে শুরু করে রাতের অন্ধকার। আমার জীবন থেকেও মীরা কোথায় হারিয়ে যেতে শুরু করে, আমি সেটি একদমই লক্ষ্য করি না।