পোস্টস

প্রবন্ধ

গাজা গণহত্যা: যুদ্ধ ও ব্যবসায়

২৭ এপ্রিল ২০২৪

সামদানী প্রত্যয়

মূল লেখক সামদানী প্রত্যয়

যুদ্ধ নাকি ব্যবসা? 
কেন এ প্রশ্ন  করছি? পরে বলছি। তার আগে কিছু শব্দ শুনুন। ফিলিস্তিন গাজা রামাল্লা পশ্চিম তীর কিংবা নানান রকম দুক্ষ আর দুর্দশার চিত্র। এসব দেখে মানুষের গা শিওরে ওঠে। মানসপটে ভেসে ওঠে কিছু অমানবিক নির্যাতন হামলায় নিহত আহত অসংখ্য মানুষের ছবি। 

কিন্তু আপনি কী জানেন এই ফিলিস্তিনের গাজা বেশ ধনী অঞ্চল। বিশ্বাস হচ্ছেনা? চলুন দেখা যাক। 

গাজা ও ফিলিস্তিনজুড়ে রয়েছে বিপুল প্রাকৃতিক সম্পদের সম্ভাবনা। জ্বালানীর আধার এই ফিলিস্তিন অঞ্চলে তেল রয়েছে ১.৫ বিলিয়ন ব্যারেল ও প্রাকৃতিক গ্যাস রয়েছে ১.৪ ট্রিলিয়ন কিউবিক ফিট। ভূতত্ত্ববিদ ও প্রাকৃতিক সম্পদ অর্থনীতিবিদরা ফিলিস্তিন অঞ্চলে বিপুল পরিমাণ তেল ও গ্যাস মজুদের বিষয় নিশ্চিত করেছেন। তারা বলছে ফিলিস্তিনের পশ্চিম তীরের এরিয়া সি আর ভূমধ্য সাগরগর্ভে থাকা গ্যাস ও তেলের মূল্যমান ট্রিলিয়ন ডলার। জাতিসংঘের কনফারেন্স অন ট্রেড এন্ড ডেভেলপমেন্টের এক প্রতিবেদনে এ তথ্য জানা গেছে। 

১৯৯৯ সালে গ্যাস অনুসন্ধানের জন্য ব্রিটিশ গ্যাস গ্রুপ ২৫ বছরের চুক্তি করে ফিলিস্তিনের সাথে। ১৭ থেকে ২১ নটিক্যাল মাইলের মধ্যে দুটি কূপ খোড়া হলে বিপুল গ্যাসের সন্ধান মেলে। যার সম্ভাব্য মূল্য ধারণা করা হয় ২ থেকে ৬ বিলিয়ন ডলার। 

নয় বছর পরের গল্প শোনা যাক, ২০০৭ সাল। সে বছর গাজার নিয়ন্ত্রণ নেয় হামাস। অপারেশন কাস্টলিডের নামে চলে নির্বিচার হামলা। যার ফলে প্রায় ১৫০০ ফিলিস্তিনি প্রাণ হারায়। এই অপারেশন কাস্টলিডের ঠিক এক বছরের মধ্যেই ইসরায়েল ঘোষনা দেয় নতুন একটি গ্যাসফিল্ড শনাক্ত করার। যার নাম দেওয়া হয় লেভিয়াথান  গ্যাস ফিল্ড, যার অন্তর্ভূক্ত ছিল গাজার সমস্ত গ্যাসক্ষেত্র। এই প্রাকৃতিক সম্পদ সব মিলিয়ে যার দাম ধারণা করা হয় ৪৫৩ বিলিয়ন ডলারেরও বেশি। 

এই মুনাফার ভাগ গাজা ও ফিলিস্তিন অংশ না পাওয়ায় গাজার রাজস্ব ক্ষতি হয় ৭.৭ বিলিয়ন ডলারেরও বেশি। ইসরায়েলের জ্বালানি মন্ত্রী কারিন এলহারাব বলেছিলেন, 'ছোট দেশ হলেও বিশ্ব জ্বালানি বাজারের গুরুত্বপূর্ণ অবস্থান তৈরি করার জন্য ইসরায়েলের জন্য এটি একটি ঐতিহাসিক মুহূর্ত। একটি সমঝোতা স্মারকের মাধ্যমে প্রথমবারের মত ইউরোপে গ্যাস রপ্তানি করতে যাচ্ছে ইসরায়েল। এছাড়াও আমরা গত বছর আরো কিছু চুক্তি করেছি যা ইসরায়েলকে বিশ্বের কাছে গুরুত্বপূর্ণ করে তুলবে।' 

এবার এই পুরো অঞ্চলের মানচিত্রের দিকে একটু চোখ বোলানো যাক। রাশিয়া ইউক্রেন সংকটের পর রাশিয়ার তেল গ্যাসে নিষেধাজ্ঞা দেয় যুক্তরাষ্ট্র। আর ইরানের ওপর নিষেধাজ্ঞা তো বেশ পুরোনো। সিরিয়ার তেলের খনিগুলো দীর্ঘদিন ধরে রয়েছে মার্কিনীদের নিয়ন্ত্রণে। সিরিয়ার প্রধান বন্দর লাতাকিয়ায় বোমা হামলা চালিয়েছে ইসরায়েল।  আর তার পাশেই লেবাননের বৈরুত বন্দরের অবস্থাও তথৈবচ। ইউরোপের যে জ্বালানি সংকটের প্রশ্ন তার সমাধান কোথায়। এ প্রশ্নের সমাধান এবং উত্তর দুটোই লুকিয়ে আছে ইসরায়েল ও তার সক্রিয় বন্দরে আর পিছনে আছে মার্কিন আশীর্বাদ। 

এবার দেখুন সুয়েজ খাল। ভারত মহাসাগর হয়ে লোহিত সাগরের মধ্যে দিয়ে ভূমধ্যসাগর পর্যন্ত যে সংযোগ তা সম্ভব হয়েছে মিশরের সুয়েজ খালের মধ্য দিয়ে। সুয়েজ খালের ওপর বাণিজ্যের অনেক কিছু নির্ভর করে। শুধুমাত্র এর দৈনিক ব্যবহার দেখলেই তা বোধগম্য হয়। 
প্রতিদিন সুয়েজ খাল দিয়ে ২.৮ বিলিয়ন ব্যারেল তেল, ৯ বিলিয়ন ডলারের পণ্য, ৮ শতাংশ এল এন জি, তথা বিশ্ব বাণিজ্যের ১২ শতাংশ নির্ভর করে সুয়েজ খালের ওপর। যদি সুয়েজ খাল না থাকতো তবে কী হতো?

নয়দিনে ৭০০০ কিলোমিটার বিকল্প পথ পাড়ি দিয়ে আসতে হতো। মানে গোটা আফ্রিকা মহাদেশ। এতে জলদস্যু, ঝড় ইত্যাদিতে অনেক ক্ষতি হতো। পরিবহণ খরচ বেড়ে যেত। 
তার মানে এখন পর্যন্ত সুয়েজ খাল বিকল্পহীন বাণিজ্যপথ। 

তবে থেমে নেই এর বিকল্প তৈরির চেষ্টা। ১৯৬০ সাল থেকে সুয়েজ খালের বিকল্প তৈরির চেষ্টা অব্যাহত রয়েছে। এর প্রস্তাবিত নাম বেন গুরিয়ান খাল। এর উদ্যোক্তা আমেরিকা। খালটি শুরু হবে লোহিত সাগরে, ইসরায়েলের মধ্যে দিয়ে ২৬০ কিমি এর বেশি পথ পাড়ি দিয়ে যুক্ত হবে ভূমধ্যসাগরে। ঠিক গাজার উত্তরাঞ্চলে। যেখানে হামলা আক্রমণ মৃত্যু এখন নিত্যদিনের ঘটনা। এই খাল নির্মাণ করা গেলে সুয়েজ খালের আধিপত্য কমবে এবং একচ্ছত্র আধিপত্য কমবে। এক অর্থে অনেকখানি ক্ষমতা হারাবে মিশর। 

এই মিশরই আবার মার্কিন ঋণ মওকুফের বিনিময়ে গাজায় বাস্তুচ্যুতদের আশ্রয় দেবে বলে গুঞ্জন আছে। তাহলে এ যুদ্ধ কী শুধুই আদর্শ বা অস্তিত্ত্বের লড়াই, নাকি তা একান্তই বিশ্ব বেনিয়াদের ছক। 

ইসরায়েলের বর্তমান জ্বালানিমন্ত্রী ইসরায়েল কাতজ বলেন, দরপত্র জেতা প্রতিষ্ঠানগুলো তিন বছরে যা বিনিয়োগ করবে তাতে যথেষ্ট পরিমাণে প্রাকৃতিক গ্যাস পাওয়া সম্ভব। 

সম্প্রতি তেলাবিব ছয়টি বহুজাতিক প্রতিষ্ঠানকে বারোটি নিবন্ধন হস্তান্তর করেছে। যার মূল লক্ষ্যই গাজা অঞ্চলের তেল গ্যাস সংগ্রহ।

 এই পুরো অঞ্চলের বিন্যাসই বেশ কৌশলীভাবে সাজানো। লোহিত সাগরের শেষভাগে ইরিত্রিয়ায় আছে ইসরায়েলের গোয়েন্দা দপ্তর, তার ঠিক দক্ষিণে ইথিওপিয়ার জিবুতিতে আছে চীনের নৌ ঘাঁটি। যা দেশটির বেল্ট এন্ড রোড ইনিশিয়েটিভ এর অন্যতম ভিত্তি। এই বেল্ট এন্ড রোড আবার পশ্চিমাদের দীর্ঘদিনের মাথাব্যথার কারন। 

তাহলে আরেকবার ভাবুন, যুদ্ধ মানেই তো ধ্বংস, যুদ্ধ মানেই তো মৃত্যু। নানান রকম লাভ ক্ষতির হিসাব নিকাশ, হার জিতের গল্প, আর ইতিহাস রচনা। কিন্তু এত শব্দের অর্থের ভেতরে আসল অর্থ আদতে কী?