পোস্টস

গল্প

সামথিং ক্যাজুয়াল

২২ এপ্রিল ২০২৪

Shifat Binte Wahid

মূল লেখক সিফাত বিনতে ওয়াহিদ

মনোগ্যামি ইজ ইনজুরিয়াস টু হেলথ- বিন্স অ্যান্ড অ্যারোমাতে বসে কথাটা বলামাত্রই চারপাশে হাসির রোল পড়ে গেল। ৭-৮ জনের একটা এই জমায়েতে একজন শুধুমাত্র চুপ করে আমার দিকে কিছুক্ষণ তাকিয়ে ছিল। কয়েকবার চোখাচোখি হলেও তার চোখগুলো ঠিকভাবে পড়া গেল না। বিস্ময়, কৌতূহল, আকর্ষণ, রাগ…জেদ! কিছু একটা আছে, এবং সেটা বেশ তীব্র!

সপ্তাহের একদিন আমি এই ক্যাফেটাতে বসি। অধিকাংশ দিনই আমার কম্প্যানিয়ন আমি নিজেই। মাঝে মাঝে এই গ্রুপটার সঙ্গে দেখা হয়ে যায়। এদের একজন আমার বেস্ট ফ্রেন্ডের ছোট ভাই যারিফ। যারিফের কারণেই এই গ্রুপটা আমার ক্লোজ হয়ে ওঠেছে। ওরা সবাই ইউনিভার্সিটিতে সেকেন্ড-থার্ড ইয়ারে পড়ে। বয়সে এত বড় একজন নারীর সঙ্গে ওদের আড্ডা দিতে তেমন অসুবিধা হয় না, বরং বেশ জমেই যায়। অবশ্য আমার ধারণা, পৃথিবীর খুব কম মানুষই আমার উপস্থিতি আর আড্ডাকে উপেক্ষা করতে পারে। ক্ষেত্র বিশেষে বরং পছন্দই করে। পুরুষদের ক্ষেত্রে ঘটনা যদিও ভিন্ন। এ ব্যাপারে আমার অবজার্ভেশন হচ্ছে- প্রেমে পড়ার ঠিক আগ মুহূর্তটাই প্রকৃত প্রেম, বাকিটা অভিযুক্ত হয়ে থাকার প্রক্রিয়া মাত্র! তো যতদিন বন্ধুত্ব থাকে, পুরুষদের কাছে এসব আড্ডা উপভোগ্যই লাগে, তবে ওই প্রক্রিয়ার মধ্যে পড়ে গেলে সবকিছুতেই কিছুটা তেতো ভাব চলে আসে।

সন্ধ্যার এই সময়টা ক্যাফেতে প্রচুর ভিড় হয়। বিশেষ করে এই স্মোকিং জোনটায়। ইয়ং ছেলে-মেয়েরাই এখানে বেশি আসে। কেউ কেউ ব্যবসায়ীক আলাপ সারতেও এখানে বসে যায়। আজকে একজন মধ্যবয়স্ক ভদ্রলোক আর ভদ্রমহিলাকেও দেখা যাচ্ছে। হাত ধরে বসে আছেন। হুট করেই ভদ্রলোকের ফোন আসলো আর উনি দেখলাম তর্জনীটাকে ঠোঁটের মধ্যে চেপে ধরে পাশে বসে থাকা ভদ্রমহিলাকে ইশারা দেখালেন চুপ থাকতে। সম্ভবত উনার বউয়ের ফোন হবে! নাও হতে পারে। তবে ভদ্রমহিলার অতি আহ্লাদে মুখটা নিমিষেই গম্ভীর হয়ে যাওয়া অন্তত তা-ই ইঙ্গিত করে। ক্যাফের সাউন্ড সিস্টেমে বাজছে, “চলে গেছো তাতে কী, নতুন একটা পেয়েছি, তোমার চেয়ে অনেক সুন্দরী…” গ্রুপের ছেলে-মেয়েগুলাও মাঝে মাঝে গানে সুর দিচ্ছে। এই ক্যাফের এটা একটা মজার বিষয়। অন্য সময় বেশ সিলেক্টিভ স্লো মিউজিক বাজালেও সন্ধ্যা থেকে রাত ১০-১১টা পর্যন্ত তরুণদের চাঙ্গা করার জন্য ভাইব বুঝে গান ছাড়ে। 

“আপু, আপনি কি পলিগ্যামাস” মিন্ট লেমোনেডটা মাত্রই মুখে দিচ্ছিলাম, এমন সময় গ্রুপের এক ছেলে আমাকে প্রশ্নটা করলো। যারিফসহ সবাই অধীর আগ্রহে আমার মুখের দিকে তাকিয়ে আছে উত্তরের অপেক্ষায়। শুধু একজনের চোখ মোবাইলের দিকে। সে এই প্রশ্নের উত্তর জানার ব্যাপারে দৃশ্যত আগ্রহ না দেখালেও তার চোখে-মুখে বিরক্তির ছাপ স্পষ্ট। হালকা এক সিপ লেমোনেড মুখে দিয়ে প্রশ্নকারী ছেলেটার চোখ বরাবর তাকিয়ে বললাম, ডু ইউ কনসিডার ইউরসেলফ অ্যা মনোগ্যামাস? আমার কথা শেষ না হতেই যারিফ পাশ থেকে বলে ওঠলো, “আর ইউ কিডিং, ব্রো! ওর তো ভার্সিটিতে একটা লাগে, বাইরে গেলে একটা লাগে, এলাকাতেও একটা লাগে!” চারপাশে আবারও হাসির হট্টগোল লেগে গেল।

ফোনটা বেজে ওঠতেই বুঝলাম ১০টা বেজে গেছে, এবার ওঠতে হবে। সবার কাছ থেকে বিদায় নিয়ে উবারে ওঠতেই ফোনে টেক্সট পেলাম- “সো, ইউ আর পলিগ্যামাস?” এই মুহূর্তে টেক্সটটা ইগনোর করতে হচ্ছে। জীবনের কোনো ঘটনা থেকেই পালিয়ে বেড়ানোর প্রবণতা নেই আমার। পালানোর প্রবণতা থাকলে কিছুদিন বিন্সে আসা এড়িয়ে চলতাম। এই মুহূর্তে টেক্সটের রিপ্লাই দিয়ে লাভ নেই বলেই এড়াতে হচ্ছে। গত প্রায় কয়েক মাস যাবত এমন অনেক অস্বস্তিকর টেক্সটেরই মুখোমুখি হতে হচ্ছে আমাকে। প্রথমদিকে রিপ্লাই দিয়েছি, তাতে খুব একটা লাভ হয়নি, বরং টেক্সটের ভাষা আরো বেশি এগ্রেসিভ হয়েছে। এখন রিপ্লাই দিতে গেলে মনে হয় নিজের পজেটিভ এনার্জি নষ্ট করছি। এরচেয়ে চুপ থাকা ভালো।

ফোনের রিঙ আবারও বেজে চলছে। রাকিন। আমার বেস্ট ফ্রেন্ড। ভেবেছিলাম বাসায় ফিরে ফোন ব্যাক করবো। সেটা মনে হয় সম্ভব হবে না। ফোন না ধরা পর্যন্ত এই বান্দা ফোন দিয়েই যাবে। বেশিক্ষণ ফোন না ধরলে এদিকে-সেদিকে আমার খোঁজ লাগানোর জন্য ফোন চলে যাবে। ফোন ধরতেই ওই পাশ থেকে ঠান্ডা গলায় বললো, “আর ইউ স্টিল আউটসাইড? হোয়াটস রঙ উইদ ইউ? আর ইউ ডেটিং সামওয়ান?” মুডটা খারাপ হয়ে ছিল, ওর প্রশ্নে হেসে ফেললাম। আই’ম নট ডেটিং সামওয়ান, এটা রাকিন নিজেও জানে। তবে আমাকে নিয়ে ওর ভীষণ ভয় আছে। আসলে আমাকে নিয়ে নয়, আমার বর্ডার লাইন পারসোনালিটি ডিজঅর্ডার নিয়েই ও ভয়ে থাকে। ও জানে, কোনো একটা সম্পর্ক বা কোনো মানুষ থেকে বের হওয়ার জন্য আমি অনেক মানুষের সঙ্গে কথা বলা শুরু করি। এসব ক্ষেত্রে দুই-একটা ঘটনা ঘটে যায় যেটা রাকিনের পছন্দ না। ও আমাকে অসংখ্যবার এসব করা থেকে বাধা দিয়েছে কড়া ভাষায়। ওর ভাষ্যমতে, আমি এসব করি রাগের মাথায়, জেদ করে। এ ধরনের মানুষই আমি না। এসব করে পরে আমি নিজেই ব্যাডবাজ খাই। ডিপ্রেশনে পড়ি। তাই অন্য সময় সে আমার খোঁজ নেক বা না নেক, কোনো সম্পর্ক বা ব্যক্তির থেকে বের হওয়ার সময় ও সবসময় আমাকে চেক-এ রাখে। এবার এ রকম কিছু ঘটেনি। মাস ছয়েক আগে একজনের সঙ্গে সম্পূর্ণভাবে যোগাযোগ বিচ্ছিন্ন হওয়ার পর পৃথিবীর কোনো পুরুষের প্রতিই আমি আর আকর্ষণ পাচ্ছি না। রাকিনের এটা না বুঝতে পারার কথা না।

আমার হাসি শুনে রাকিন আবার বললো, “আই’ম আস্কিং সামথিং? আর ইউ উইদ সামওয়ান?” আমি হাসতে হাসতেই নিচু স্বরে বললাম, হ্যাঁ। উবারের ড্রাইভারের সাথে। এবার ওর কণ্ঠ কিছুটা স্থির হলেও পুরোপুরি নিশ্চিন্ত হয়েছে বলে মনে হলো না। কিছুক্ষণ ও পাশ থেকে গড়গড় করে ওর গার্লফ্রেন্ড মাইশা ওর কথা শোনে না, চান্স পেলেই বন্ধু-বান্ধবের সঙ্গে খোলামেলা কাপড় পরে বের হয়, কয়েকদিন আগে নাকি ওকে মিথ্যা বলে কোন বন্ধুর সঙ্গে বারেও গিয়েছিলসহ নানা অভিযোগ করলো। ওকে বুঝিয়ে লাভ নেই। এর আগে বহুবার আমি মাইশার ব্যাপারে বুঝিয়েছি। মাইশা এভাবেই বড় হয়েছে, হুট করে এক-দুই মাসে কেউ কারো এত দীর্ঘদিনের অভ্যাস চেঞ্জ করতে পারে না। তারপরও তো মেয়েটা চেষ্টা করছে। রাকিনের সঙ্গে ওর বয়সের ডিফরেন্সটাও তো অনেক বেশি। আমাদের সময় আমরা যেভাবে বড় হয়েছি, ওদের বেড়ে ওঠাটা তো ডিফরেন্ট। একদিনেই কাউকে চেঞ্জ করে ফেলতে চাইলে তো তারও দমবন্ধ হয়ে আসবে এই রিলেশনে। জোর করে কি কিছু চেঞ্জ করা যায়? ও যদি সত্যিই রাকিনকে চায়, তবে নিজেই চেঞ্জ হবে। রাকিনকে এসব বলতে গেলেই ও ওর নিজের লজিক দেখানো শুরু করবে, লজিক দেখানোর ক্ষেত্রে ও আমার বাপ! তাই আমি পারতপক্ষে এসবক্ষেত্রে হুম-হ্যাঁ বলে এড়িয়ে যাই। তবে মাঝে মাঝে আমি ছাই দিয়ে কৈ মাছ ধরার মতো ওকে ঠিকই ধরি, ইচ্ছামতো বকাবকিও করি। এখন করতে ইচ্ছে করছে না। অনেকক্ষণ যাবত আমার হুম-হ্যাঁ শুনে রাকিন অপরপ্রান্ত থেকে গড়গড় থামিয়ে বললো, “ডিড হি কল ইউ?” ওর প্রশ্নে চমকে ওঠলাম। বুঝতে পেরেও জানতে চাইলাম, কে? “তুই ভালো মতোই জানিস কে।” রাকিন উত্তর দিলো। একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলে বললাম, নাহ। ফোন দেবে কেন? কেউ চলে যেতে চাইলে কি ফোন দেয় নাকি? রাকিন কিছুক্ষণ চুপ থেকে বললো, “মন খারাপ?” আবারও হাসার চেষ্টা করে বললাম, নাহ। আই’ম ফাইন। দুই বন্ধু মিলে ফোনে খুনসুটি করতে করতে বাসার কাছাকাছি চলে এলাম।

বৈশাখ মাস চলে। গত ৫ দিন প্রচণ্ড দাবদাহ ছিল। বাসার কাছে আসতেই বিদ্যুৎ চমকিয়ে বাতাস ছাড়লো। বৃষ্টি আসবে সম্ভবত। ঘরে ঢুকে ফ্রেশ হয়ে বারান্দায় গিয়ে বসতেই ফোনে টেক্সটের সাউন্ড শুনলাম। ফোন হাতে নিয়ে দেখি, একই নম্বর থেকে মেসেজ- “ইউ ডিডেন্ট এন্সার। আর ইউ পলিগ্যামাস? আমি তো জানি আপনি মিথ্যা বলেন না! নাকি সবই আপনার ভণিতা?” আই ডিড অ্যা মিসটেক! আই ডিড অ্যা ফাকিং বিগ মিসটেক, যার জন্য আমার এখন এমন বিরক্তিকর পরিস্থিতি ফেস করতে হচ্ছে। জীবনে যেকোনো এলিগেশন আমি হজম করতে পারলেও “মিথ্যাবাদী” হিসেবে নিজেকে মেনে নিতে আমার আপত্তি আছে। অনিচ্ছা সত্ত্বেও মেসেজটার রিপ্লাই দিলাম- ইট ওয়াজ ইউ, হু টুকস থিংগস ইন আদার ওয়ে। উত্তর আসলো, “আই শ্যুড হ্যাভ টোল্ড- ফাক ইউ! বাট আই কান্ট।”

লাগাতার আমাকে মেসেজ পাঠানো ছেলেটার নাম সাদাফ। যারিফের বেস্ট ফ্রেন্ড। এই ছেলে আমাকে এমন টেক্সট পাঠানোর দুঃসাহস কীভাবে করতে পারে, যে কেউ জানলেই এই প্রশ্নটা করবে। দোষটা আসলে আমারই। আমার গিলটি ট্রিপে থাকার বাজে অভ্যাস আছে বলে এমনটা ভাবছি, রাকিন শুনলে এমনটাই বলতো। সমস্যা হচ্ছে, এ কথা রাকিনকে বলা সম্ভবই না। এ কারণেই একা একা সব হজম করে যাচ্ছি। যারিফ রাকিনের আপন ছোট ভাই। সে হিসেবে সাদাফও রাকিনের অনেক কাছের। সাদাফকে রাকিন চোখের সামনেই ছোট থেকে বড় হতে দেখেছে। একটা অনাকাঙ্ক্ষিত ঘটনার জন্য আমার ২৪ বছরের বন্ধুত্বে প্রশ্ন তৈরি হবে, এটা আমার পক্ষে মেনে নেওয়া সম্ভব না। রাকিনের কাছ থেকে তাই ব্যাপারটা গোপন করতে হয়েছে।

আজকের মতোই এক বৃষ্টিস্নাত রাতে বিন্সে বসে আড্ডা দিচ্ছিলাম। জীবন আর সম্পর্ক নিয়ে সেখানে নানা আলাপ চলছিল। গ্রুপের সব ছেলে-মেয়েরা আমার গল্প শুনছিল মনোযোগ দিয়ে। শুনছিল সিলভিয়া-টেড হিউজের প্রেম আর বিচ্ছেদের গল্প। মুগ্ধ হয়ে বোঝার চেষ্টা করছিল জ পল সাত্রের কাছে লেখা সিমন দ্য বেভয়রের সুইসাইড নোটের মর্ম। আর এসবের মাঝে ফ্রয়েডের ব্যাখ্যা চলে আসাটা তো কমন একটা বিষয়ই। তো সেই রাতে বাসায় ফেরার জন্য সবার কাছ থেকে বিদায় নিয়ে সিঁড়ি দিয়ে নামতে গিয়ে দেখি, সাদাফও আমার পেছন পেছন নামছে। উবার কল করার জন্য ফোন চাপছি, এমন সময় ও পাশে এসে বললো, “এত সুন্দর ওয়েদারে রিকশায় ঘুরতে ভালো লাগে না আপনার?” আমি হেসে দিয়ে উবার ক্যান্সেল করলাম। ওর দিকে তাকিয়ে বললাম, চলো! রিকশায় ঘোরা যাক। ওই রাতে ঘণ্টা খানিক রিকশায় ঘুরে বিদায় নিয়েছিলাম। পুরো রিকশা জার্নিতে আমাদের আলোচনার বিষয় ছিল সিলভিয়া প্লাথ আর টেড হিউজের সম্পর্ক এবং আমি কেন দুনিয়ার এত ফুটবলারকে বাদ দিয়ে রবার্ট লেভানডফস্কিকে পছন্দ করি, সেসব। আমার ডিপ্রেশনের ফেজ চলছিল। কিছুই ভালো লাগে না’র ওই সময়ে রিকশা জার্নিটা আমাকে কিছুটা হলেও যে ভালো লাগিয়েছিল, সেটা অস্বীকার করার মতো অকৃতজ্ঞ আমি না।

ওই রিকশা জার্নির পরই সাদাফের টেক্সট আসা শুরু করে ঘন ঘন। অধিকাংশই সাহিত্য আর ফিলোজফি রিলেটেড কথাবার্তা। মাঝে মাঝে আমি ফ্রি কি না, বের হতে চাই কি না, বিন্সে যাবো কি না- এসব প্রশ্নও থাকতো। আমার ব্যস্ততা বা দুনিয়াদারির চিন্তা থেকে দূরত্ব এসব প্রশ্নকে অস্বাভাবিক লাগায়নি। এরমধ্যে একদিন বিন্সে গেলাম। সাদাফ সেদিন আমার পাশের সিটটাতে এসে বসলো। আমার মনে এটা নিয়ে অন্যকিছু ভাবার অবকাশ ছিল না। ওইদিনও আড্ডা শেষে উবারের বদলে রিকশায় ওঠা হলো, সাথে সাদাফও ছিল। বাসার কাছাকাছি পৌঁছে বিদায় নেওয়ার মুহূর্তে ও হ্যান্ডশেক করে আমার হাত ঘামছে কেন এমন প্রশ্নে কয়েকবার হাত স্পর্শ করলো। তখনও মনে হয়নি আমাকে নিয়ে ও অন্যকিছু ভাবতে পারে। বিদায় নেওয়ার সময় ঠাট্টা করেই বললো, “বাসায় কফি খাওয়ার দাওয়াত তো দিতে পারেন!” আমি হেসে বললাম, দো আই’ম নট অ্যা কফি লাভার, তবে একদিন তো খাওয়াই যায়। ওইদিন রাতে সাদাফ টেক্সট করে জানতে চাইলো, “আর ইউ সিঙ্গেল অর টেকেন?” উত্তরে আমি লিখলাম, অ্যান্ড অল আই লাভড, আই লাভড এলোন!

পরের দিন দুপুরে, অফিসে কাজের চাপ কম ছিল। গ্রিন টির কাপ হাতে নিয়ে বেগম আখতারের সঙ্গে গুন গুনাচ্ছিলাম, "চুপি চুপি চলে না গিয়ে, সে কেন বিদায় নিলো না হেসে...।" এরমধ্যেই সাদাফের টেক্সট পেলাম। জানতে চাইলো, "আজকে কি একসঙ্গে কফি খেতে পারি?" লোনলিনেসটা চাগাড় দিয়ে ওঠলো কি না জানি না, সন্ধ্যায় গ্লোরিয়া জিন্সে চলে গেলাম কফি খেতে। সাদাফ কিছুটা আগেই চলে গিয়ে আমার জন্য নিচে দাঁড়িয়ে ওয়েট করছিল। ভ্যাপসা গরমে ঘেমে একাকার হয়ে যখন আমি রিকশা থেকে নামলাম, সামনে এগিয়ে এসে ও হাত বাড়িয়ে দিলো। দুজনে কফি অর্ডার দিয়ে সাহিত্য আর সিনেমার গল্পে মশগুল হয়ে গেলাম। ও আমাকে সাজেস্ট করলো "দ্য অনলি লিভিং বয় ইন নিউ ইয়র্ক" দেখতে। আমরা কিছুক্ষণ ডিফেন্স মেকানিজম নিয়ে আলাপ করলাম। হাসতে হাসতে আমি বলছিলাম, দেখো কতভাবে আমরা জীবনে ডিফেন্স মেকানিজম অ্যাপ্লাই করছি। ও জানতে চাইলো কীভাবে? ওর ঠোঁটে সিগারেট জ্বলছে। সেদিকে তাকিয়ে প্রশ্ন করলাম, সিগারেট ক্ষতিকর জানার পরও এটা ছাড়ো না কেন? ও বললো, "আরেএএএএএহ, সবার কি আর ক্যান্সার বা লাং-এ সমস্যা হয় না কি?" আমি আরো জোরে হেসে দিয়ে বললাম, সি...দিস ইজ ডিফেন্স মেকানিজম। সিগারেট ক্ষতিকর জেনেও তুমি আনকনশাসলি ব্যাপারটাকে রিফিউজ করছো যে এটা তোমার জন্য ক্ষতিকর। আমার কথা শুনে ও হেসে দিলো।

এদিকে-সেদিক আলাপের মাঝে হুট করেই ও প্রশ্ন করলো, "কালকে একটা প্রশ্ন করেছিলাম, আপনার রিপ্লাইটা অনেক কনফিউজিং ছিল। সাহিত্যের স্টুডেন্টরা কি সহজভাবে কথা বলতে পারে না?" আমি জানতে চাইলাম, কোন প্রশ্নটা বলো তো! ও একটু ইতস্ততই হয়েই প্রশ্নটা আবার করলো, "আর ইউ সিঙ্গেল অর টেকেন?" আমি কিছুটা অস্বস্তিতেই পড়ে গেলাম। আমি অবশ্যই সিঙ্গেল, কিন্তু মনের সমস্ত অংশ জুড়ে যদি অন্য কারো বসবাস থাকে, সেই সম্পর্ককে কী বলে? "হার্টশিপ"! বাহ, একটা সুন্দর নাম হয়েছে তো। মনে মনে এসব ভেবে সশব্দেই হেসে দিলাম। সাদাফ কফির কাপে চুমুক দেওয়া থামিয়ে বোকার মতো তাকিয়ে আছে আমার মুখের দিকে। হাসি থামিয়ে বললাম, "সাহিত্যের স্টুডেন্টদের সঙ্গে আড্ডা দিবা, তাদের কথার তাৎপর্যও তো বোঝার চেষ্টা করতে হবে। এনিওয়ে, আই'ম নট টেকেন, দো আই লাভ সামওয়ান হু নেভার লাভড মি। নেভার উইল হি।" ওর ভ্রুটা কুঁচকে গেল। কিছুটা চিন্তার ভাঁজ দেখলাম কপালে। এসির মধ্যেও বিন্দু বিন্দু ঘাম জমতে দেখলাম নাকে। এবার কফির কাপে চুমুকটা দিয়েই জানতে চাইলো, "আর ইউ লুকিং ফর সামথিং?"

মাথার মধ্যে আবার বেগম আখতার চাড়া দিয়ে ওঠলো..."আমি তো রাখিনি তাকে বেঁধে, শুধু ভুল করেছি ভালোবেসে...চুপি চুপি চলে না গিয়ে, সে কেন বিদায় নিলো না হেসে...।" বুঝলাম আলাপ কিছুটা গম্ভীর আর বিব্রতকর দিকে চলে যাচ্ছে। হালকা করার জন্যই বললাম, আই'ম লুকিং ফর শত্রুজ! মজার ব্যাপার কি জানো, যেসব পুরুষরা আমাকে কখনো ভালোবাসেননি, তারাও কখনো আমার খারাপ কোনোদিন চাননি। মাঝেমধ্যে মনে হয়, এই শুভাকাঙ্ক্ষী হয়ে থাকার চেয়ে আমার শত্রু পালা আরামদায়ক ছিল। হা হা হা। আমার কথাবার্তা ওর বিশেষ পছন্দ যে হচ্ছে না, মুখ দেখেই বোঝা যাচ্ছে। কফির কাপটা একবার ডানে, একবার বামে ঘুরাতে ঘুরাতে বললো, "আই রিয়েলি ওয়ান্ট টু নো দ্য এন্সার।" ফোনটা বেজে ওঠলো। রাকিনের কল। সাইলেন্ট করে কিছুটা ঠান্ডা গলায় জবাব দিলাম, অল আই নিড সাম পিস। কাউকে দূর থেকে ভালোবাসছো কখনো? সাইলেন্টলি ভালোবাসার মধ্যে বিশাল আনন্দ আছে। নো এক্সপেকটেশন, নো কমিটমেন্ট, নো ব্রেক আপ! দেয়্যার ইজ অনলি লাভ...! আর ধরো আমি যদি কিছু বা কাউকে খুঁজিও, সেটা অবশ্যই তোমার বয়সী কারো কাছ থেকে না। মুহূর্তেই ওর মুখটা কালো হয়ে গেল যেন সারা দুনিয়ার মেঘ ওর মুখে এসে জমাট বেঁধেছে। শেষের বাক্যটা আমি কেন বলেছিলাম, সত্যিই জানি না। কথা বলতে বলতে মুখ থেকে বের হয়ে গেছে। হয়তো সেটা ওর এই প্রশ্ন জানার তাগিদ থেকেই হয়েছে। আমার ব্রেন বোধহয় আমাকে সতর্ক হতে সিগনাল দিচ্ছিল।

সে রাতে গ্লোরিয়া থেকে ফেরার পর কয়েকদিন আর সাদাফ কোনো টেক্সট করেনি। আমিও অফিসের কাজ নিয়ে ব্যস্ত ছিলাম। সপ্তাহ খানিক পর বিন্সে আবার দেখা হলো আমাদের। সবার সামনে তেমন একটা কথা বললো না। বিদায় নেওয়ার আগে ওখানে বসেই সাদাফ টেক্সট পাঠায়, "ক্যান আই ড্রপ ইউ হোম?" আমি লিখলাম, শিওর। পুরোটা রাস্তায় তেমন একটা কথা হলো না। বাসার কাছাকাছি পৌঁছে ও জানতে চাইলো, "একজন আপনাকে ভালোবাসে না জেনেও হোয়াই ইউ আর ওয়েস্টিং ইউর টাইম?" ওর প্রশ্নে কিছুক্ষণ চুপ থেকে জবাব দিলাম, আমি তো আমার হৃদয় ইনভেস্ট করতে নামি নাই যে লাভ-লোকসান হিসাব করবো! আই চুজ দিস লাইফ কনশাসলি। দ্যাটস মাই হ্যাপিনেজ। আমি আমার মনের আনন্দকে সম্মান করি। বাসার কাছে নেমে আমরা হাঁটতে হাঁটতেই কথা বলছিলাম। ও কথার প্রসঙ্গ চেঞ্জ করে বললো, "আপনার বাসায় কিন্তু এখনো যাওয়া হলো না।" ভদ্রতাবশত বলতে হলো, একদিন চলে আসো। কাউকে বাসায় ডাকার ব্যাপারে অবশ্য আমার অ্যালার্জি আছে। পারতপক্ষে কাউকেই আমি বাসায় ডাকি না। আমার এই একলার সাম্রাজ্যে কিছু সীমানা আমি নিজে থেকেই নির্ধারণ করে রেখেছি, সবার সেখানে প্রবেশাধিকারের গেট পাস নাই। বেচারার সম্ভবত আরেকবার মনটা খারাপ হলো।

এরপর কিছুদিন সাদাফ নরমাল টেক্সটই করতো- কেমন আছেন, কাজের চাপ বেশি নাকি, কখনো কাফকার মেটামরফোসিস নিয়ে আলাপ তো কখনো মার্কেজের ম্যাজিক রিয়ালিজম। ম্যাক্সিমামই ক্যাজুয়াল কথাবার্তা। এরমধ্যে একদিন সাদাফ লিখে পাঠালো, "আমার আপনার সঙ্গে অনেক ইম্পোর্টেন্ট কথা আছে, আমরা কি আপনার বাসায় বসে কথা বলতে পারি?" ব্যাপারটা খুব আনইউজ্যুয়াল হলেও ছোট ভাইয়ের বন্ধুকে নিয়ে কোনো ধরনের ইনসিকিউরিটি ফিল করার ভাবনা আমার মাথায় আসেনি। আমি আসতে জানিয়ে কিছু স্ন্যাকস কিনে বাসায় ফিরলাম। ও বাসায় আসার পর আমার বইয়ের কালেকশন দেখার ফাঁকে কফি বানিয়ে আনলাম। ঘরের মরিচা বাতির আবছা আলোতে বেজে যাচ্ছিল কাভিশ-এর "তেরে ওয়াস্তে সাবহি রাস্তে, ছোড়কে মে আয়ি হু ইয়াহা। তু তো না মিলা, ইউহি চাল দিয়া
লেকে মেরা দিল জানে তু কাহা...।" 

বাইরে বৃষ্টির শব্দ শুনে বারান্দায় দৌড় লাগালাম শুকনা কাপড় তুলতে। হুট করেই টের পেলাম সাদাফ পেছন থেকে আমাকে জড়িয়ে ধরেছে। এত সাডেন ব্যাপারটা ঘটলো যে আমি হতভম্ব হয়ে দাঁড়িয়ে থাকলাম। কয়েক সেকেন্ড ও ওর সমস্ত শক্তি দিয়ে আমার শরীরটাকে পিষে ফেলছিল। আমি একইভাবে শক্ত হয়ে দাঁড়িয়ে ছিলাম। ও কিছুক্ষণ পর ছেড়ে দিয়ে ঘরের ফ্লোরে গিয়ে বসে পড়লো। আস্তে আস্তে বারান্দার সবগুলো কাপড় তুলে ঘরে ফিরলাম। কিছুক্ষণ দুজনই চুপচাপ বসে ছিলাম। আমার সমস্ত শরীরে একটা অদ্ভুত বাজে অনুভূতি হচ্ছিল। গা গুলাচ্ছিল। কী বলবো বোঝার আগেই সাদাফ এসে আমার হাত ধরে বললো, "আই'ম সর‍্যি। আই হ্যাভ ফিলিং ফর ইউ, আই জাস্ট কুডেন্ট ইগনোর ইট।" আই রিয়েলি ডিডেন্ট এক্সপেক্ট দিস। নীরবতা ভেঙে আমি ঘড়ির দিকে তাকিয়ে বললাম, ইটস টু লেট। বৃষ্টিও থেমে গেছে বোধহয়। তোমার বাসায় যাওয়া উচিত। নিচের গেট ১১টায় বন্ধ করে দেয়। ও আমার হাতটা একইভাবে চেপে রেখে বললো, "আই থট আপনার ক্যাজুয়াল সম্পর্কে সমস্যা নেই। আমি সত্যিই আপনাকে পছন্দ করি।" এবার কিছুটা কোল্ড হয়েই বললাম, প্লিজ, লিভ।

এই ঘটনার পর কিছুদিন আমি বিন্সে যাবো না বলে চিন্তা করেছিলাম। কিন্তু এরপরই মনে হয়েছে, আই ডিডেন্ট ডু এনিথিং রঙ। আমাকে কেন পালিয়ে থাকতে হবে! সাদাফকে এর পরের সপ্তাহে বিন্সে দেখিনি। তবে ওর এই না আসাটা বেশি দিনের জন্য ছিল না। সপ্তাহ ঘুরতেই ওকে দেখা গেল এবং ওইদিন থেকে ও আমাকে আবার টেক্সট করাও শুরু করলো। এর বেশিরভাগই আমাকে ব্লেইম করে- আমি কেন ওর সঙ্গে ঘুরলাম, ওকে স্পেস দিলাম, ওর মনের সঙ্গে এভাবে খেলা করলাম, আমি সেলফিশ, নিজের আনন্দ খুঁজতে ওকে ইউজ করেছি ব্লা ব্লা ব্লা। ওর একেক সময় একেক রকম টেক্সটের রিপ্লাই প্রথমদিকে দিলেও এক সময় সেটা বন্ধ করতে বাধ্য হলাম। লাভ হচ্ছিল না। বরং টেক্সটের রিপ্লাই দিলেই ও আরো এগ্রেসিভ হয়ে ওঠছিল।

বাইরে প্রচণ্ড বাতাস শুরু হয়েছে। বারান্দায় গেলাম কাপড় তুলতে। এরমধ্যেই আবার টেক্সট পেলাম সাদাফের, "আপনি তো পলিগ্যামাস না। এইসব ভাব নিয়ে কী প্রমাণ করতে চান? আপনি আসলে যতটা মর্ডার্ন নিজেকে প্রুভ করতে চান, তারচেয়ে অনেক বেশি ক্ষ্যাত।" পুরুষ মানুষ, যেই বয়সেরই হোক না কেন, প্রত্যাখ্যান সহ্য করতে পারে না। প্রত্যাখ্যাত হলে তারা আহত বাঘের মতো সুযোগের অপেক্ষায় থাকে। সুযোগ পেলেই ক্ষত-বিক্ষত করে। আমার এই রিকশায় ঘোরা, কফি খেতে যাওয়া, আড্ডা দেওয়াকে কেউ ইন্টিমেট কিছু ভেবে নিয়েছে ভাবতেই দমবন্ধ লাগা শুরু হলো। হু হু বাতাসে চারপাশ থেকে নোনামাটির গন্ধ ভেসে আসছে। রাকিনকে ফোন দিলাম। এ সময় আমার ফোন দেওয়াটা আনইউজ্যুয়াল বলেই হয়তো দুইটা রিঙে ফোনটা রিসিভ করলো ও৷ "কী রে, এই সময়? ঘুমাস নাই?" জানতে চাইলো ওই পাশ থেকে। আমি চুপ করে আছি। দুজনই কিছুক্ষণ চুপ থাকার পর ও নীরবতা ভেঙে বললো, "আর ইউ মিসিং হিম?" অস্পষ্ট স্বরেই বললাম, জানি না। অপরপ্রান্ত থেকে উত্তর আসলো, "ইউ নো ইট ওয়েল, দ্যাট ওয়াজ ক্যাজুয়াল।" পাশের বিল্ডিং-এর কোনো এক ফ্ল্যাটে বাজছে, "শ্রীকৃষ্ণ বিচ্ছেদের অন.....লে, অঙ্গ যায় জ্বলিয়া ভ্রমর....কইয়ো গিয়া...।" গানের শব্দগুলোতে বুকটা কেমন দুমড়ে-মুচড়ে ওঠলো।