পোস্টস

গল্প

কিছু তাপীয় ও পাপীয় উপাখ্যান

২২ এপ্রিল ২০২৪

রাশেদ স্বপ্ন

মূল লেখক রাশেদ স্বপ্ন

.
ওরা যখন আমার পায়ে কিম্ভুতকিমাকার জিনিসটি লাগিয়ে দিল তখন আমি ব্যাথা, বেদনা কিংবা কোনপ্রকার শারীরিক অনুভুতি অনুভব করিনি। আমার বরং কিছুদিন আগের কথা মনে পড়ছিল। তখনকার কথা, যখন আমার শরীর জুড়ে বিরাজ করছিল একটি ভয়ঙ্কর অনুভুতি। মনে হচ্ছিল খুব সম্ভবত আমি মারা যেতে চলেছি। 

বিকেলের সূর্য তখন নিভু নিভু। প্রতিমুহুর্তেই আকাশের রঙ বদলে যাচ্ছে। বাতাসে মিশে আছে শীতের হিমহিমে ছোঁয়া। অনেক ওপরে কুন্ডলী পাকিয়ে থাকা মেঘেরা নিজেরাই একেকটা চিত্রকর্ম হয়ে আকাশে ভাসছে। যেন দেয়ালছবির মত করে তারা সাজিয়ে তুলেছে মস্ত বড় আকাশটা। শেষ বিকেলের নরম রোদে চারপাশে একটা অদ্ভুত সোনালী আভার সৃষ্টি হয়েছে। এরকম এক সুন্দর বিকেলে আমি নিজের মৃত্যু পরোয়ানায় সই করলাম।

আমরা চারজন বন্ধু। আমি, টোটো, ববি আর চার্লি। আমি আর ববি সহোদর। চার্লি আমাদের মায়ের দিকের খালাত বা মামাত টাইপের ভাই। লতায় পাতায় সম্পর্ক। তাই স্পষ্ট করে জানি না যে আসলে কোনটা। বয়সে আমার চেয়ে এক বছরের ছোট। টোটো আমার বয়সী। আমাদের প্রতিবেশি। আমার বেস্ট ফ্রেন্ড। সবার ছোট ববি। আমার আদরের ছোট ভাই।  

ববির জন্মের সময়ের কথা আমার মনে আছে। তখনো রাতে মায়ের সাথে ঘুমাই। বুকের মধ্যে চুপ করে শুয়ে থাকলে ওঁর শরীর থেকে মাতৃত্বের গন্ধ নাকে ভেসে আসে। সেখানেই ভীষণ আরাম। আরো ছিলাম বেজায় ঘুমকাতুরে! সেই রাতে আশেপাশে কী হল কিছুই টের পাইনি। একসময় কে যেন আমাকে জাগিয়ে দিল। কিছু একটা বলল। ঘুম ঘুম চোখে ভাল করে বুঝতে পারিনি কী বলেছে। শুধু শুনলাম বাবার কাছে গিয়ে শুতে হবে এমন কিছু বলছে। চোখ দুটো অর্ধেক বুজে রেখেই আমি জায়গা বদল করে ঘুমিয়ে পড়েছিলাম। তারপর আর কিছু মনে নেই।

সকাল হতেই দেখলাম একটা বাচ্চা। ছোট্ট। ভীষণ আদুরে। ঘুমিয়ে কাদা হয়ে আছে। জানলাম সে আমার ছোট ভাই। গত রাতেই নাকি জন্মেছে। বাবা খুব শখ করে ওর নাম রেখেছেন ‘ববি’। বেবি নামে তো আর সারাজীবন একটা ছেলেকে ডাকা যায় না, তাই না? তাই বেবিকেই এদিক ওদিক করে ‘ববি’ রাখা হয়েছে। 

আমাদের মাঝে টোটো ভীষন শক্তিশালী। বয়সের তুলনায় গায়ের জোর অনেক বেশি। একাই দু তিনজনকে ধরে বেদম কেলানি দিতে পারে। আমাদের পাড়ার লোকাল সেলিব্রেটি। চাচা থেকে চাচী, মামা থেকে মামী সবই টোটো বলতে অজ্ঞান। কিছুদিনের মধ্যেই ও ‘সেন্ট্রাল সিকিউরিটি ইন্টেলিজেন্স’ এর জুনিয়র ফিল্ড এজেন্ট একাডেমী-তে যোগ দেবে। দু বছরের ট্রেনিং শেষে জুনিয়র ফিল্ড এজেন্ট। তারপর আরো দুটো বছর কোনমতে পার করে ফেলতে পারলেই লোকাল সিকিউরিটি ইন্সপেক্টরের বড় চাকরী। চাকরীটাতে সম্মান আছে প্রচুর। তবে সম্মানী নেই তেমন। সে টাকা পয়সা অবশ্য আমাদের চাই ও না। আমরা মনে করি জীবনে টাকা পয়সাই সব না। সম্মানটাই আসল। তাই এলাকার বাড়িতে বাড়িতে টোটো ভীষণ কদর পায়। পাড়া-প্রতিবেশিদের মুখে সে সোনার টুকরো ছেলে! বাবা মাঝে মাঝেই আমার মাথায় গাট্টা মেরে বলতেন, “বন্ধুকে দেখে কিছু শেখো! গাধা জন্ম দিয়েছি একটা!” ও আমার মত ঘুম কাতুরে নয়। বাবার কষ্ট পাওয়াটা স্বাভাবিক।

টোটো আমাকে বিশ্বাস করত খুব। বন্ধু হিসেবে ভালোও বাসত। কিন্তু বিপরীতে আমি ওকে হিংসে করতাম। ওই দৃশ্যমান ও অদৃশ্যমান গাট্টাগুলোর জন্য আমি ওর ব্যক্তিত্বকে, ওর সাফল্যকে ভয়ানক হিংসে করতাম। সত্যি বলতে ওর জন্য আমার জীবনটা দিনকে দিন নরক হয়ে উঠছিল। উঠতে বসতে কথা শুনতাম। দেখতাম  সবসময় ওর সাথে আমার একটা তুলনা চলছে তো চলছেই। টোটো এত ভালো কিছু করছে, আর এদিকে আমি নিজের জীবনটা নিয়ে কীসব ছিনিমিনি খেলছি-এটাই ছিল তাদের অভিযোগ। এটা কীভাবে কারো অভিযোগ হতে পারে তা আমার ছোট মস্তিষ্কে ধরে না। আমার জীবন নিয়ে আমার থেকে অন্যদেরই দুশ্চিন্তা বেশি। যেমন বেশি মায়ের চেয়ে মাসির দরদ।

শারীরিক শক্তি ছাড়াও টোটোর মাথায় বুদ্ধিও ছিল অনেক। পুরোটাই জন্মগত অর্জন। এইটুকু বয়স থেকেই আর দশজনের থেকে ওকে সহজেই আলাদা করা যেত। তা হোক গায়ের জোরে, হোক মগজের জোরে। তা সে সৃষ্টিকর্তার বা জীন ব্যাংকের আনুকুল্য পাচ্ছে পাক। এই নিয়ে আমার কোনদিনই কোন অভিযোগ ছিল না। সে দৈব বৈষম্য যদি মেনেও নেই, যে প্রকট সামাজিক বৈষম্য ও নিজের অজান্তেই আমার চারপাশে সৃষ্টি করে চলছিল, তা কখনই মেনে নেয়ার মত ছিল না। চলতে ফিরতে সবাই টোটোকে জিজ্ঞেস করত, “আমার মত একটা অথর্বের সাথে ও কী করছে?” 
আমাকে অথর্ব বলার কারন আমি আসলে একদিক থেকে পঙ্গু। 


জীবের শরীরের একটি গুরুত্বপূর্ণ অঙ্গ হল নাক। এর মূল কাজ দুইটি। এক, নিশ্বাস গ্রহনে সাহায্য করা, এবং দুই, ঘ্রাণেন্দ্রিয়র কাজে সহায়তা করা। সকল স্বাভাবিক প্রাণী আর সব কিছুর সাথে নাক ও ঘ্রাণেন্দ্রিয় বিষয়ক স্বাভাবিকতাটুকু নিয়েই জন্মায়। আমিও সেভাবে জন্মেছিলাম। নাকের স্বাভাবিকতাটুকু সাথে নিয়ে। তারপর এই ‘স্বাভাবিকতা’টিই একদিন হঠাৎ করে ‘অস্বাভাবিকতা’ হয়ে গেল।

লারসন স্কয়ার এলাকার পাতি নেতা ম্যাভেরিক। কয়েক বছর ধরেই সে এলাকা ভিত্তিক রাজনীতিতে দারুণ সক্রিয়। পেশীবহুল কঠিন শরীরটা নিয়ে তাকে প্রায়ই নিজ এলাকায় ঘোরাঘুরি করতে দেখা যায়। ভাত ছড়ালে কাকের অভাব হয় না। অতএব ভিখিরি কাকের মতই কয়েকটা অনুচরও এসে জুটেছে ওর সাথে। তাদের হম্বিতম্বিতে এলাকায় সদা একটা চাপা আতঙ্ক বিরাজমান। ওই এলাকাতেই চার্লিদের বাসা। সেদিন আমি আর টোটো ওদের বাসায় যাচ্ছিলাম।  

জায়গাটা বস্তি মত। ধূলি ধূসরিত পথঘাট আর দারিদ্রে পরিপূর্ণ লাল ইটের দেয়ালের প্রাচীর ঘিরে আছে চারপাশে। ধূলো মাড়িয়ে হেঁটে যেতে যেতে টোটো আমাকে জিজ্ঞেস করেছিল, “লাস্কি শালা একটা বোকাচোদা, জানিস?”
লাস্কি আমাদের আরেকটা বন্ধু। নিরীহ দর্শন। একটু বেশিই সহজ সরল। বন্ধুমহলে তার বোকামির নিদর্শনগুলো আমাদের আড্ডায় নিয়মিত হাসির খোরাক। আমি ওর নতুন বোকামির খবর জানতাম না। ডানে-বামে মাথা নাড়িয়ে বললাম, “না, তো! কী করছে?”
বলার আগে খুব এক চোট হাসল টোটো। আমি তার হাসি থামা পর্যন্ত অপেক্ষা করলাম। কিন্তু সে থামল না। হেসেই গেল। এক পর্যায়ে বিরক্ত হয়ে বললাম, “দেখ ভাই, বলতে চাইলে বল। একা একা এমন করে খ্যাঁকাস না।”
টোটো হাসি থামালো না। সে হাসতে হাসতে বলল, “আমি একা একাই, এমন করে খ্যাঁকাই!” বলেই আবার জোরে জোরে হাসতে লাগল। ওর হাসি দেখে আমার কিছুটা রাগ হল । কথা বললাম না।
একসময় হাসি থামিয়ে টোটো বলল, “ছাগলটার তো চেহারা-সুরত ভালো। তাই দেখে ক্যাথি নাকি ক্রাশ খেয়েছিল। প্রপোজও করেছিল। ও মেয়েটাকে কী বলেছে জানিস?”
আমি অত্যন্ত বিরক্ত হয়ে বললাম, “কিছু না বলে এত জানিস জানিস করলে কীভাবে জানব?’ 
আরেক দফা হাসলো টোটো। তারপর বলল, “বলেছে ওদের মাঝে নাকি কখনো কিছু হওয়া সম্ভব না। ওর পরিবার নাকি মেনে নেবে না!
আমি অবাক হয়ে বললাম, “সেকী! কেন? কী হয়েছে ওদের পরিবারে?”
টোটো বলল, “একই প্রশ্ন তো ক্যাথিরও। ও জানতে চেয়েছিল কেন। বোকাচোদাটা ওকে বলেছে, ওদের পরিবারে নাকি শুধু নিজেদের মধ্যে বিয়ে হয়। যেমন ওর বাবা বিয়ে করেছে ওর মাকে, আপু দুলাভাইকে, ভাইয়া ভাবী কে…”
আমি হেসে দিলাম। বললাম, “গান্ডু একটা শালা…”
আমরা হাসছিলাম প্রচুর। লারসন স্কয়ারের কঠিন নীরবতা ভেঙে আমাদের হাসির আওয়াজ এলাকাটির সীমানা প্রাচীরের সাথে ধাক্কা খেয়ে ফিরে আসতে লাগল। 

ঠিক সেই সময়ে উল্টোপাশের রাস্তা দিয়ে সোজা এগিয়ে আসছিল ম্যাভেরিক আর তার দলবল। আমরা ওদের একেবারেই লক্ষ্য করিনি। তখনো হাসি ঠাট্টা করে যাচ্ছিলাম। ওরা যখন আমাদের একদম কাছাকাছি চলে আসল, ঠিক সেই তখন টোটো হাসতে হাসতে আমাকে একটা ধাক্কা দিল। মজা করেই। কিন্তু আমি তাল সামলাতে না পেরে সোজা গিয়ে পড়লাম ম্যাভেরিকের ওপর। 

স্যরি বলেছিলাম অনেক। কিন্তু হল ইগোর যুদ্ধ। তাই সেসব স্যরিতে কাজ হয়নি। ম্যাভেরিক আর তার দলবল আমাদের সাথে চরম দুর্ব্যবহার শুরু করে দিল। ওর ছেলেপেলেরা তেড়ে এলো আমাদের দিকে, “মাঙ্গের পুত চোখ বাড়িত থুইয়া আহস নাকি?”

গালি খেয়ে আমার ইগো মোডও স্বয়ংক্রিয়ভাবে চালু হয়ে গেলো। মেজাজ হারিয়ে ঝগড়া করতে শুরু করলাম। শুরুতে টোটো চেষ্টা করছিল দু পক্ষকেই নিবৃত্ত করার। কিন্তু ততক্ষনে মারামারি শুরু হয়ে গিয়েছে। ম্যাভেরিকের ষণ্ডামার্কা ছেলেপেলেরা আমাকে ধরে বেধরক পেটাতে শুরু করে দিল। মার খেতে খেতেই আমি বিস্ময়ভরা দুই চোখ নিয়ে তাকিয়ে দেখলাম, টোটো পালিয়ে যাচ্ছে। 

সেদিন মার খেয়েই আমার নাকটা একটু থেঁতলে গেলো। পাকাপাকিভাবে। একটু বেশিই থ্যাঁতলালো। ফলে বাইরের চেহারাটাও কেমন যেন বাজে দেখতে হয়ে গেলো। সেই ঘটনার পর আমার ঘ্রাণেন্দ্রিয় পুরোপুরি নষ্ট হয়ে গিয়েছে। আমি আজও কোন প্রকার ঘ্রাণ অনুভব করতে পারি না। চার্লি আমাকে পরে জানিয়েছিল, ওরা যখন আমাকে মারছিল তখন নাকি টোটো পালিয়ে ওদের বাসাতেই গিয়েছিল। সেখানে গিয়ে সে একদম স্বাভাবিক ব্যবহার করেছে। বলেছে আমি নাকি ছিলাম না  ওর সাথে।

এই শারীরিক বিকলাঙ্গতার জন্য পরবর্তীতে সবাই আমাকেই দায়ী করল। কেন আমি নিজের রাগ নিয়ন্ত্রণ করলাম না? কেন আমি গায়ে পড়ে ঝগড়া করতে গিয়েছিলাম? আমার সাথে যা হয়েছে ঠিক হয়েছে।  আমি অবাক হয়ে ভাবলাম, এ কেমন সমাজ? আমার সাথে অন্যায় হল, অথচ আমি প্রতিবাদ করব না? মুখ বুজে সব মেনে নেয়াই কী শেষ কথা?

এইভাবে জীবনের পদে পদে ব্যার্থতা ও দুর্ঘটনাজনিত কারনে গাট্টা খেয়ে চলছিলাম। কখনো পরিবারের হাতে। কখনো সমাজের হাতে। এভাবে চলতে চলতে একসময় আমার ভেতরে রাগ-ক্ষোভ-ঘৃণা সবকিছু একসাথে দানা বেঁধে উঠল। টের পেতাম এক ধরনের অশুভ অস্থিরতা আমার শরীর-মন জুড়ে প্রতিনিয়ত বয়ে যাচ্ছে। আর সে ছড়িয়ে আছে আমার পা হতে মাথা অব্দি । প্রতিটা অংগে। প্রতিটা কোষে। টোটোকে দেখলে সে কালো অনুভূতি আমার ভেতর কিলবিল করে উঠত। আমার রাগ হত। ঘৃণা হত। হিংসা হত। অনেক চেষ্টা করেছিলাম সেসব বাজে অনুভুতিগুলো এড়িয়ে যেতে। পারিনি। আমার পরিবার, আমার সমাজ আমাকে সেটি করতে দেয় নি। স্রেফ একটি বিকলাঙ্গতার জন্য ওরা আমাকে বাতিলের খাতায় ফেলে দিয়েছিল। অথচ একই জায়গায় টোটো পাচ্ছিল ভালোবাসা, সম্মান সবকিছু। 

ঠিক এই কারনে ওর হাসি, ওর আনন্দ আমাকে কখনো স্বস্তি দিত না। আমাকে ঘুমাতে দিত না। রাত হলে যখন ঘুমাতে যেতাম, আমি দুঃস্বপ্ন দেখতাম। দেখতাম টোটো হাসছে। বিকট এক হাসি। তার সাথে মিশে আছে অবজ্ঞার সুর। ওর সেই হাসির আওয়াজ আমার কানে বিঁধত কয়েকশ গুণ তীক্ষ্ম হয়ে । তারপর যন্ত্রণায় ছটফট করতে করতে ঘুম কেটে যেত। উঠে দেখতাম সমস্ত শরীর ঘামে ভিজে গিয়েছে।

তারপর সারারাত আমার আর ঘুম আসত না। ক্লান্ত চোখ নিয়ে। জেগে থাকতাম। বহু রাত এইভাবে নির্ঘুম কেটে গিয়েছে। তবে তাতেও অন্যদের অসুবিধা হয়েছে। কেন রাত জাগি? রাত জাগি বলেই নাকি আমার জীবনে কিছু হচ্ছে না। সমাজ ও পরিবারের বাক্যবাণগুলো শুনতে শুনতে কিছু সময়ে আমার মনে হত, এক নির্জন সৈকতে আমি একটা চোরাবালিতে আটকা পড়ে গিয়েছি। ধীরে ধীরে সে বালি গিলে নিচ্ছে আমাকে। আমার বাঁচার আর কোন উপায় নেই। আমাকে বাঁচাবার মত কোথাও কেউ নেই। সময়ের সাথে সাথে সে চোরাবালিতে আমি ক্রমশ তলিয়ে যাচ্ছি। একসময় ডুবে যাব। দম বন্ধ হয়ে আসবে। তারপর মরে যাব। একদম। 

নিমিরিয়াকে আমার ভাল লাগত। সে আমাদের সাথে তেমন একটা মিশত না। হঠাৎ হঠাৎ দেখা হয়ে যেত। কিন্তু ওর দেখা পেলে আমার বুকের ভেতর তখন কেমন একটা ধুকপুকানি জন্ম নিত। মনে হত সময় এবং পৃথিবী দুটোই স্থির হয়ে যাচ্ছে। হৃদস্পন্দন দ্রুত থেকে দ্রুততর হচ্ছে। নিমিরিয়া দেখতে ভীষন সুন্দর। ওর হাঁটার ভঙ্গি আরো সুন্দর। আর ওর গলার লাল রিবনটি যেখানে গথিক ফন্টে কালো কালিতে লেখা ‘নিমিরিয়া’ সেটি সবচেয়ে সুন্দর। তার গলার এই লাল রিবন আমাকে দীর্ঘদিন সব ধরণের জাগতিক যন্ত্রণা থেকে স্বস্তি দিয়ে গিয়েছিল। যখন আমার মরে যেতে ইচ্ছা হত, আমি একটি সমান্তরাল পৃথিবীর কথা চিন্তা করতাম। যেখানে নিমিরিয়া আমার স্ত্রী। আমি নিমিরিয়ার স্বামী। আমাদের একটি সংসার আছে। আদুরে আদুরে দুইটি সন্তান আছে। সর্বোপরি ভালোবাসা ও মায়ায় আমরা বেঁচেবর্তে আছি। সুখে আছি। খুনশুঁটি করছি ওর গলার সেই লাল রিবনটি নিয়ে।

নিমিরিয়াকে প্রথমবার দেখেই আমার মাথা ঘুরে গিয়েছিল। তখনও আমার ঘ্রাণশক্তি প্রবল। সব কিছুর গন্ধই স্পষ্ট করে পাই। সমাজ ও পরিবারের কাছে তখনো অথর্ব হয়ে যাই নি। সেদিন এন হোসেন এভিনিউ-এর উদ্দেশ্যে আমরা দল বেঁধে যাচ্ছিলাম। জায়গাটা আমাদের পাশের পাড়া। পাশাপাশি এই দুটো পাড়ারই নামের শুরুটা এক। এন হোসেন। তারপর ওরা এভিনিউ আর আমরা কমপ্লেক্স। অবশ্য উত্তর কোরিয়া-দক্ষিন কোরিয়ার মত প্রবল প্রতিপক্ষ আমরা হইনি। শহরের সবাই আমাদের পাড়া দুটোকে ভাই-ভাই পাড়া বলে ডাকে। আমরা থাকতামও সেভাবে। মিলেমিশে। একসাথে। ঠিক হয়েছিল দুই পাড়া মিলে একটা প্রার্থনার আয়োজন করা হবে। আসন্ন পূর্ণিমার রাতে বসবে এই প্রার্থনার আসর। শুক্লপক্ষের ভরা চাঁদ যখন আকাশ ভরে আলো দেবে, মায়াবী রোশনাই দিয়ে প্রকৃতিতে আলো-আঁধারির কুহেলিকা সৃষ্টি করবে তখন আমরা সবাই মিলে ক্লিনটন হিলে যাব। পাহাড়ের চুড়ায় উঠে আকাশের দিকে মুখ তুলে গান গাইব। আমরা গাইব আমাদের সুপ্রাচীন প্রার্থনা সংগীত। আমাদের জন্য। আমাদের পূর্বপুরুষদের জন্য। এমনকি যারা এখনো পৃথিবীতে আসেনি, তাদের জন্যেও।  

সেই শোডাউনের সময়েই আমি ওকে প্রথম দেখেছিলাম। সবার সামনে ছিলাম আমি। অপেক্ষা করছিলাম রাস্তা পার হব বলে। ঠিক তখন ও আমাদের দলটার এক হাত সামনে থেকে হেঁটে চলে গেল। সেই সামান্য নৈকট্যেই আমি অবাক হয়ে দেখলাম কী উদ্ধত দৃষ্টি তার! আর কী আত্মবিশ্বাসী পদচারণা! আর…আর নিমিরিয়া যখন আমার সামনে দিয়ে চলে গিয়েছিল, আমি ওর শরীরের গন্ধটি পেয়েছিলাম। মিষ্টি একটা সৌরভ। তবে শুধু মিষ্টি নয়। তার সাথে মিশে আছে একটা ভিন্ন রকম আদিম গন্ধ যা ভাষায় প্রকাশ করা ভীষণ কঠিন।  সে গন্ধ অদ্ভুত মাদকতাময়! অবিশ্বাস্য! ঘ্রাণেন্দ্রিয় বিকল হওয়ার আগ অব্দি, সে গন্ধ লেগেছিল আমার নাকে। আজ বহুদিন হল সেই গন্ধ আমার কাছে আসে না। 

ছোট যখন আমি ছিলাম, একদিন বাবা আমাকে সিকলিডদের গল্প শুনিয়েছিলেন। গল্পটি তাঁকে শুনিয়েছিলেন তাঁর বাবা। অর্থাৎ আমার দাদা। 

দক্ষিন আমেরিকার আমাজন নদীর অসংখ্য নালা চলে গিয়েছে আমাজন বনের ভেতর। সেখানে গিয়ে তারা পুরো বনভূমি জুড়ে ছড়িয়ে পড়েছে। সেই নালাদের ভেতর কিছু জলজ উদ্ভিদের আবাস। সোর্ডটেইল, ওয়াটার স্প্রাইট, সোর্ডপ্লান্ট, ডাক উইড আর কচুরীপানার সেই ঘন জঙ্গল নালাগুলোর জলের ওপরে নিচে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকে। জলের তলায় সে যেন আরেক জলজ আমাজন! প্রাণের প্রাচুর্যে ভরপুর। পানির রঙ সেখানে কোথাও কোথাও কালচে হয়ে গিয়েছে। দেখলে মনে হয় যেন গাঢ় লিকারের র’ চা। ওখানেই বাস করে সিকলিডরা। থ্রি স্পাইন সিকলিড। 

সিকলিডদের জীবনাচারণ অদ্ভুত। নালার তলদেশে পুরুষ সিকলিডরা গর্ত খোঁড়ে। একটা সংসারের জন্য। একটা পরিবারের জন্য। তারপর নিজের হাতে বানানো সেই বাড়িটি ওরা সাজায়। পাথর দিয়ে। জলজ বনের ছোট ছোট গাছপালা দিয়ে। যাতে স্ত্রী সিকলিডরা সেই বাড়ির সৌন্দর্য দেখে আকৃষ্ট হয়। যাতে তারা সেখানে ডিম পাড়ে। তারপর স্ত্রী সিকলিডরা যার বাসা পছন্দ করে, সেখানেই ডিম পেড়ে রেখে চলে যায়। আর পুরুষটি গভীর মমতায় ডিম ফুটিয়ে শিশুদের বড় করে তোলে।

টোটোও ওদের মতই নিজেকে গুছিয়ে নিয়েছিল। হাজারো ছেলেমানুষী আর খুনশুঁটির ভেতর দিয়েই ঠিক ঠাক ভাবে নিজেকে নিয়ে গিয়েছিল একটা উজ্বল ভবিষ্যতের দিকে। সিকলিডদের বাড়ি সাজানোর মত করে সে নিজের বুদ্ধিমত্তা আর শারীরিক শক্তি দিয়ে নিজেকে দারুণভাবে সাজিয়েছিল। নিমিরিয়ার তাতে আকৃষ্ট না হয়ে কোন উপায় ছিল না। প্রকৃতির নিয়ম মেনে তার শরীরের গন্ধের মতই নিমিরিয়াও আমার কাছে আসলো না। একসময় আমার নিজেকেও সিকলিড বলে মনে হতে লাগল। তবে স্পাইনলেস সিকলিড। সামর্থ্যবান হবার মত মেরুদন্ড যার নেই। 

দীর্ঘদিন যাবৎ আমি ভাবছিলাম নিমিরিয়াকে মনের কথা খুলে বলি। কিন্তু সাহস করে উঠতে পারিনি। তারপর ভিন্ন এক সুন্দর বসন্তের বিকেলে আমি ওদের দুজনকে একসাথে দেখলাম। 

ক্লিনটন হিলের চারপাশটা খোলা মেলা নয়। ঘন জঙ্গল ঘিরে আছে পাহাড়টাকে। সে নিজেও ন্যাড়া নয়। প্রচুর গাছপালা আর ঘাস লতাপাতায় ভর্তি। পাহাড়ের  পাদদেশ ধরে কিছুটা ওপরে উঠে গেলে পথের দুপাশে সারি সারি রডোডেনড্রন ফুটে থাকতে দেখা যায়। রডোডেনড্রনের সারিগুলো পার করে যেতেই কিছুটা সামনেই পড়ে গ্লোরিবোয়ারের একটা ঘন ঝোঁপ। সাদা সাদা ফুলগুলো ঝোঁপের ভেতর মায়া ভরা রুপ নিয়ে ফুটে থাকে। দেখলেই মন শান্ত হয়ে আসে। সেই বিকেলে ঘুরতে ঘুরতে আমি সেই ঝোঁপটির কাছে গিয়ে হাজির হয়েছিলাম। প্রায়শ এরকম উদ্দেশ্যহীনভাবে ঘোরাঘুরি করতে করতে আমি ক্লিনটন হিলে চলে যেতাম। কিছুটা সময় সবার থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে থাকতে পারায় ভালোই লাগত। কিন্তু সেদিন গ্লোরিবোয়ারের সাদা ফুল কিংবা লাল-হলুদ রডোডেন্ড্রনরা আমার মন ভোলাতে পারেনি। বরং অপ্রত্যাশিত একটি দৃশ্য আমার মন ভুলিয়ে দিয়েছিল! 

গ্লোরিবোয়ারের সবচাইতে বড় আর ঘন ঝোপটার নিচে আমি টোটোকে দেখেছিলাম। ওর সাথে নিমিরিয়াও ছিল। খুব ঘনিষ্ঠ হয়ে বসেছিল ওরা। আমি দেখলাম টোটো নিমিরিয়ার কানের কাছে মুখ নিয়ে কিছু একটা বলল। নিমিরিয়া সেটি শুনে লাজুক মুখে হাসল। তারপরই অপ্রত্যাশিত একটি দৃশ্যের অবতারণ হল। চুমু খেলো ওরা। দীর্ঘক্ষণ ধরে। চুম্বনপর্ব শেষ হলে আমার বন্ধুটি অকস্মাৎ নিমিরিয়ার গায়ের গন্ধ শুঁকতে লাগল। দেখতে পেলাম ও মেয়েটার সারা শরীর শুঁকছে। পা হতে মাথা অব্দি! প্রতিটা রোম কূপের গোড়ায় গোড়ায় ঘ্রাণ নিচ্ছিল টোটো। তারপর আমাকে অবাক করে দিয়ে ও নিমিরিয়ার শরীরে জিভ বোলাতে শুরু করল। ও মেয়েটাকে চাটছিল! আমি দেখলাম টোটো নিমিরিয়ার দেহের প্রতিটি বর্গ ইঞ্চিতে চাটল। ঠিক যেভাবে সে মেয়েটার সারা শরীরের গন্ধ শুঁকছিল!  

বাস্তবিকভাবেই এই দৃশ্য আমি বেশিক্ষন সহ্য করতে পারিনি। ফিরতি পথ যখন ধরেছিলাম তখন ক্লিনটনের নিচে প্রায় সন্ধ্যা নেমে এসেছে। পাহাড় থেকে নামতে নামতে আমার মাথায় অল্প কিছু শব্দ বনবন করে ঘুরতে লাগল। নিমিরিয়ার গায়ের গন্ধ! 

তারপর অনেকদিন আমি স্থির হয়ে কোথাও বসতে পারিনি। চোখ বুজলেই দেখতে পাই নিমিরিয়ার শরীর। দেখতে পাই টোটোর লালচে জিভ। দেয়াশলাই এর বাক্সের দুপাশের কাগজে মিশে থাকা ফসফরাস আর মিহি কাঁচের মিশ্রণের মতন সে জিভ বিস্ফোরক! তার সাথে ঘর্ষণ হওয়া মাত্র নিমিরিয়ার শরীরে কামনার আগুন দাউ দাউ করে জ্বলে উঠেছে। ধনুকের মত বাঁকা হয়ে যাচ্ছে ওর শরীর। ওরা দুজন মিশে যাচ্ছে দুজনার সাথে। স্পর্শ নিচ্ছে। ঘ্রাণ নিচ্ছে। পিষে ফেলছে একে অপরকে। 

আমি ঠিক করেছিলাম টোটোকে মেরে ফেলতে হবে!

ভাবনাটি সহজ ছিল না। কিছুদিন ধরে আমার নিজেরই মরে যেতে ইচ্ছা করছিল। মনে হচ্ছিল বেঁচে থেকে এইসব যন্ত্রণা সহ্য করা কঠিন। ভীষন কঠিন। শুধু নিমিরিয়া কেন, কোন নারীদেহের গন্ধই উপভোগ করা আমার পক্ষে সম্ভব নয়। টোটোর মত করে তো নয়ই। অসহ্য মানসিক কষ্টের সেই সময়ে আমি হাতের কাছে যাই পেতাম তার ভেতরেই নিজের নাকটি ডুবিয়ে দিতাম। জোরে জোরে নিশ্বাস নিতাম। গন্ধ পাওয়ার চেষ্টা করতাম। প্রকৃতিতে মিরাকল ঘটে খুব কম। সে ভাগ্য আমার ছিলও না। তাই প্রতিবারই যোগফল হত শুন্য। আমি কোন গন্ধ পেতাম না। 
 
জীবনের না পাওয়াগুলোর সাথে যখন প্রিয় বন্ধুর পাওয়াগুলোর তুলনা আমি করতাম, আমার মনে হত বেঁচে থেকে বিশেষ লাভ নেই। তাই মরে যাওয়াই উত্তম। এতে সবার উপকার। আমারো কথা শুনতে হবে না। দেখতে হবে না প্রিয় বন্ধু ও পছন্দের মানুষের শরীর চাটাচাটির মত আপত্তিকর দৃশ্য। 
 
কিন্তু এইসকল চিন্তা যখন আমার মনে ঘুরে বেড়াচ্ছিল, তখন টোটোর প্রতি আমার সেই হিংসা, সেই ঘৃণারা যেন নতুন করে জ্বালানী পেল। ভয়ঙ্করভাবে জ্বলে উঠল ওরা। সেই অনুভুতিরা আমাকে বলল, মরবি, তবে একা কেন? তোর একার দোষ নাকি? ওই যে হারামজাদা টোটো, তার দায় নেই? সবার সাথে তো তোর তুলনা করে না। ওর সাথে করে কেন? স্রেফ ভালো বন্ধু বলে? নিমিরিয়াকে ছিনিয়ে নিয়ে গেল কে? কে শুঁকলো ওর দেহ? ওই ঘ্রাণেন্দ্রিয়র পুরোটুকু সুবিধা কে আদায় করে নিল?
 
এত গুলো প্রশ্নবাণে জর্জরিত হয়ে আমি ঠিক করলাম মরে তো যাবোই। তবে টোটোকে নিয়ে মরব। 
 
পরিকল্পনা জটিল নয়। ক্লিনটন পাহাড়ের উত্তর দিকে একটা গভীর খাদ আছে। পাহাড়চূড়ার ওই দিকটা একদম খাড়া নিচে নেমে গিয়েছে। পরিকল্পনা করলাম, টোটোকে ভুলিয়ে ভালিয়ে পিকনিকে যাওয়ার নাম করে নিয়ে যাব একদিন। তারপর সুযোগমত খাদের কিনারায় নিয়ে ধাক্কা দিয়ে ফেলে দেব নিচে। নিজের বেঁচে থাকার চিন্তা নেই। তাই পরিকল্পনা হল তীরের মত সোজা। ঠিক করলাম সুযোগমত একটু দূর থেকে দৌড়ে এসে আচমকা ওকে নিয়েই ঝাঁপ দেব।  

আরো কিছুদিন ইতিহাসের পাতায় চলে গেল। সময়ঘড়ি এগিয়ে গেল আরো কিছুটা। সমস্ত পরিকল্পনা শেষ করে একদিন টোটোকে প্রস্তাবটা দিলাম। 
“একটা পিকনিক করা দরকার বুঝলি?” 
টোটো চোখ কপালে তুলে বলল, 
“পিকনিক? পিকনিক কেন?”
আমি ওকে বোঝাতে শুরু করে দিলাম,
“দেখ, তুই আছিস আর একটা সপ্তাহ…”
 
টোটো রাজি হল সহসাই। প্রথম ধাপ শেষ করতে তেমন বেগ পেতে হলো না। ঠিক তখন থেকেই একটা চাপা উত্তেজনা আমার সমস্ত শরীর জুড়ে ভর করতে শুরু করে দিল। টোটোকে দেখলেই মনে হত,আর অল্প কিছুদিন। তারপর মারা যেতে চলেছে সে। 
না, বন্ধু-হত্যার এই পরিকল্পনা আমার ভেতরে কোন গ্লানিবোধের জন্ম দেয়নি। যা কিছু ভেবেছি, যা কিছু করেছি, সবই আমার কাছে অত্যন্ত স্বাভাবিক মনে হয়েছিল। বস্তুত একটা স্থায়ী মানসিক প্রশান্তির জন্য আমি মুখিয়ে ছিলাম। যা অর্জনের সহজ পন্থা হিসেবে টোটোকে দুনিয়ে থেকে সরিয়ে দেয়াই মনে হচ্ছিল সঠিক। 
 
সেদিন সেই সুন্দর আলো ঝলমল সোনালী বিকেলে আমরা হাত পা ছড়িয়ে ক্লিনটনের ঢালে শুয়েছিলাম। পিকনিক শেষ হয়ে গিয়েছে। বিশ্রাম পর্ব চলছে। খানিকবাদেই আমরা ফিরে যাব। তারপর স্রেফ একটা সুন্দর স্বাভাবিক বিকেলের গল্প হয়ে থাকবে আজকের এই সময়। কিন্তু এই স্বাভাবিকতা তখন আমার কাম্য ছিল না। আমি চেয়েছিলাম সব শালারা কাঁদুক। আমার জন্য হবে না সে আমি জানি। টোটোর জন্যই কাঁদুক ওরা। ওদের কান্না আমি যদিও শুনতে পাব না। তবু ওরা যে কাঁদবে, সে দৃশ্য মানসচক্ষে অবলোকন করেই আমি গভীর পরিতৃপ্তি অর্জন করলাম। তখনো সুযোগ পাইনি বলে মেজাজ খিঁচ মেরে ছিল কিছুটা। একবারের জন্যেও টোটো ওই খাদের আশেপাশেও যায়নি। শুয়ে শুয়ে আকাশের দিকে তাকিয়ে ভাবছিলাম কিভাবে খাদের কিনারে ওকে নিয়ে যাওয়া যায়। শিকার হাতের মুঠোয় ধরা না দিলে, শিকারীকেই পথ খুঁজে নিতে হয়। ভয়ানক দক্ষতার সাথে সারতে হয় সমস্ত শিকার প্রক্রিয়া। 
 
ফরচুন ফেভারস দি ব্রেভ।  ঠিক এমন সময়, আমি অপ্রত্যাশিত সৌভাগ্যের দেখা পেয়ে গেলাম। গভীর চিন্তায় ডুবে ছিলাম বলেই হয়ত টের পাইনি কখন টোটো গিয়ে ওই খাদের কিনারে দাঁড়িয়েছে। উদাস ভঙ্গিতে তাকিয়ে আছে চারপাশে। দৃশ্যটি চোখে পড়া মাত্র আমার দুই চোখ জ্বলে উঠল। চারদিকে একবার তাকালাম। বেলা পড়ে এসেছে। সূর্যের আলো নিভে যাওয়া শুরু করবে একটু পরেই। চার্লি আর ববিকে দেখতে পেলাম না কোথাও। ওরা কোথায় গিয়েছে জানিনা। 
 
তবে ওদের কথা ভাবার সময়ও নেই। প্রত্যক্ষদর্শী না থাকাটা ভালো হয়েছে। ভাবলাম আর দেরি করা চলে না। সুযোগ যখন হাতের কাছে এসেই পড়েছে, পরিকল্পনা বাস্তবায়ন করতে হবে এখনই। তীক্ষ্ণ নজরে আমি টোটোকে দেখতে থাকলাম। ও তখনো একভাবে স্থির হয়ে তাকিয়ে আছে। রোদের আলো সরাসরি ওদিক থেকেই আসছে বলে পেছন দিকটা ছায়ার মত করে দেখতে পাচ্ছিলাম। পাহাড়ি বাতাসের আদিম পাথুরে ঘ্রাণ বুক ভরে নিতে নিতে আমার শরীরের সকল মাংসপেশী টান টান হয়ে উঠল। বাঁকানো ধনুকের টানে সবেগে ছিটকে বেরিয়ে যাওয়া তীরের মত করে আমিও ছুট লাগালাম। পায়ের নিচে এবরো থেবরো অসমান ক্লিনটন হিলের পাহাড়ি জমিন। কষ্ট হচ্ছিল দৌড়োতে। তবু থামলাম না, কিংবা গতি কমালাম না। নিজের এবং টোটোর জীবনের সমাপ্তি ঘটানোর এক অপ্রতিরোধ্য মরণাকাঙ্খায় আমি ছুটে চললাম। আমার কানের পাশ দিয়ে শোঁ শোঁ শব্দে ছুটে যেতে লাগল বৈকালিক পাহাড়ি বাতাস।
    
ছুটতে ছুটতে একদম কাছে চলে এসেছি যখন, ঠিক তখন টোটো পেছন ফিরল। সম্ভবত আমার পায়ের আওয়াজ পেয়েই ঘুরেছিল। আর কিছু ভাবার সময় ছিল না আমার। ওর থেকে কয়েক ফুট দূরে থাকতেই আমি সবেগে লাফ দিলাম। ঘটনা আকস্মিকতায় হতবিহ্বল টোটো কিছু বলার সুযোগ না পেয়েই আমার ধাক্কায় গড়িয়ে পড়ল  খাদ বেয়ে। আমিও পড়ে যাচ্ছিলাম। বস্তুত শুণ্যে ভাসছিলাম তখন। আমার নীচে গভীর গিরিখাদ। সেই খাদের গহীন অন্ধকারের দিকে ছুটে যেতে আমার মনে হল, এই আরেকটু। তারপর মিলিয়ে যাব ওই ছোট্ট ব্ল্যাক হোলে। আমার একটু সামনেই টোটো। তীব্রবেগে ছুটে যাচ্ছে খাদের গভীরে। ওর চীৎকার একবারের জন্যেও আমার কানে পৌঁছায় নি। প্রতিশোধের নেশায় আমি রীতিমতো অন্ধ এবং কালা হয়ে গিয়েছিলাম। টোটোর মৃতদেহ ব্যতিরেকে আর কিছুই আমার চোখের সামনে ভাসেনি। ওর আর্তনাদের আওয়াজ ছাড়া আমি আর কিছু ভাবতেও পারিনি।  

চলে যেতে কেমন লেগে আমি ঠিক সেই  মুহুর্তে জানলাম। এই সোনালী আকাশ, সবুজ পাহাড় আর চেনা প্রকৃতির সব রূপ সব রঙ তুচ্ছ মনে হতে হতে হাসি ফুটে উঠল আমার মুখে। মিশন সফল হয়েছে। বস্তুত আমি চিন্তা করতেই চাই নি আমি না থাকলে বা আমার মৃত্যুতে কারো কিছু আসবে যাবে কি না। আমি জানতাম যাবে না। তাই এই খুন এবং আত্মহত্যার যুগলবন্দী অপরাধটি করতে গিয়ে আমি জ্বালানী পেয়েছি টোটোর মৃত্যুর কথা ভেবে। কীভাবে ওর পরিবার কাঁদবে, কীভাবে ওর বন্ধুবান্ধব-আত্মীয়স্বজনরা কাঁদবে, কীভাবে নিমিরিয়া কাঁদবে-এইসব চিন্তাভাবনা আমার মনে প্রতিশোধের আগুন আরো কতকটা উষ্কে দিত। বিশেষত নিমিরিয়ার কথা মনে পড়লেই আমার পাগল পাগল লাগত। অনেকদিন ধরে বিরাট পাথরের মত ভারী সেই যন্ত্রণা ও হিংস্রতা বুকের ভেতর বয়ে নিয়ে বেরিয়েছি। ঠিক সেই মুহুর্তে মৃত্যু পথে ধাবিত হতে হতে আমার মনে হল সেই ভারটা যেন নেমে গেলো একেবারে। ধীরে ধীরে একটা শান্তির হাসি ফুটে উঠেছিল আমার মুখে। তখনো ছুটে যাচ্ছি নিচে। মাত্র কয়েক সেকেন্ডের অবসর। তারপর সেই গহীন অন্ধকারে আমি তলিয়ে যাব। সমাপ্তি যে এত সুন্দর হতে পারে তা আমার জানা ছিল না।

তবে টোটোর মৃত্যু আমার মনে যে তৃপ্তি ও প্রশান্তির হাসি ফুটিয়েছিল, তা ছিল সাময়িক। খাদের অন্ধকারে ডাল পালা মেলে থাকা বুড়ো গাছটাকে ওপর থেকে একেবারেই দেখা যায়নি। তারই একটা শাখার ওপর তীব্র বেগে আছড়ে পড়লাম। মনে হল বাম পায়ের মধ্য দিয়ে হাই-ভোল্টেজের বিদ্যুৎ চলে গেলো। মট করে একটা শব্দও শুনতে পেলাম। আর তারপরই সমস্ত শরীর ছাপিয়ে জেগে উঠল যন্ত্রণা। অন্ধকারের পর্দা চোখে নেমে আসার আগে কিছু কোলাহল ভেসে এসেছিল কানে। এমন অসময়ে এই ঘন জঙ্গলে কারা আসতে পারে তা খুঁজে বের করার মত শক্তি আমার তখন ছিল না। ভাঙা পায়ের তীব্র যন্ত্রণায় জ্ঞান হারালাম তৎক্ষণাৎ। 

জ্ঞান ফিরে আসতেই নিজেকে বিজাতীয় একটি হাসপাতালে আবিষ্কার করলাম। ওখানকার প্রাণীগুলো ডাক্তারের পোশাক পরনে। ব্যস্ত ভঙ্গিতে ছোটাছুটি করছিল ওরা। আমি দেখলাম, আমার বাম পায়ের নিচের অংশটুকু যেখানে থাকার কথা সেখানে নেই। বুঝলাম পা টা হারিয়েছি। ঘ্রাণ-প্রতিবন্ধী তো ছিলামই আগে থেকে। এবারে হলাম খোঁড়া। একটা দীর্ঘনিশ্বাস ছেড়ে বসে রইলাম। আশেপাশে পরিচিত কাউকে দেখতে পেলাম না। হঠাৎ কয়েকজন বিজাতীয় প্রাণিরা এসে আমার পায়ে এই কিম্ভুতকিমাকার জিনিসটা লাগিয়ে দিয়েছে। জিনিসটা ভালো। দুটো চাকা আছে সাথে। চলাফেরায় দারুণ উপকার।

কিন্তু এই উপকার নিয়ে বেঁচে থাকা কঠিন হয়ে গেলো যখন হাসপাতাল থেকে ছাড়া পেয়ে পথিমধ্যে আমি নিমিরিয়া আর টোটোকে দেখলাম। ক্লিনটনের পাথুরে রাস্তায় ওরা হাঁটছিল। কোথায় যাচ্ছিল তা বুঝতে আমার বেগ পেতে হল না। কিন্তু নিজের দুই চোখকে প্রবলভাবে অবিশ্বাস করতে শুরু করে দিলাম। আমি নিজ হাতে ওকে ধাক্কা দিয়ে নিচে ফেলে দিয়েছি। বুড়ো গাছটা আমাকে বাঁচালেও ওকে বাঁচায়নি। খাদের অতল অন্ধকারে টোটো তলিয়ে গিয়েছে। স্পষ্ট দেখেছি আমি। 

আধিভৌতিক কিছু দেখে ফেলেছি ভেবে আমি পা বাড়ালাম। ভেবেছিলাম আমার পরিবার হয়ত ধরেই নিয়েছে যে আমি পাহাড়ের খাদ থেকে পড়ে গিয়ে বন্ধুর সাথে মারা গিয়েছি। খানিকটা গোপনেই ওদের দেখার প্রবল ইচ্ছে হল বলে, যতখানি পারা যায় মুখ লুকিয়ে আমি বাড়ির পথে রওনা হলাম। তারপর থেকে আমি আর ওই এলাকায় ফিরে যাইনি। বাড়িতে গিয়ে বুঝতে পারলাম আমি ভুল দেখিনি রাস্তায়। টোটোই ছিল সে। ওর সাথে নিমিরিয়াও ছিল। ওরা বাস্তবজগতেরই বাসিন্দা। কামতাড়িত হয়ে পাহাড়ের ঝোপের আড়ালে যাচ্ছে। সেখানে কিছু প্রেম ও কামের চূড়ান্ত বিনিময় হবে। টোটো এখনো বাস্তব তার কারন আমি, এক হতভাগা, হিংসুটে, জীবনযুদ্ধে ব্যার্থ আর ক্রোধে অন্ধ একটা জীব রোষ-তাড়িত হয়ে সেদিন টোটোকে ফেলতে গিয়ে ববিকে ফেলে দিয়েছিলাম পাহাড় থেকে। উল্টোপাশের রোদের আলো আর ওর পেছন ফিরে থাকা দেখে আমি ভেবেছিলাম ওটাই বুঝি টোটো। 

লুকিয়ে লুকিয়ে বাবা-মায়ের কান্না আমি বেশিক্ষণ সহ্য করতে পারিনি। যে অপরাধবোধের গ্লানি সেইদিন আমার মনে জেগে উঠেছিল, তারও মোকাবেলা করতে পারিনি। পরিবার ছেড়ে, এলাকা ছেড়ে পালিয়ে এলাম। এখন শুধু পথ হেঁটে যাই। কোথা থেকে কোথা যে যাই তা আমি জানি না। কেউ খেতে দিলে খাই, না দিলে খাই না। তবে রোজই পথ হাঁটি। তবে সেই পথযাত্রায় আমার চারপাশে কি ঘটে চলেছে, তার দিকে খুব একটা মনোযোগ পড়ে না আমার। আমি শুধু জানি পরিবার-নিমিরিয়া-টোটো আর ক্লিনটন হল থেকে আমাকে বহুদূরে পালিয়ে যেতে হবে। কিন্তু জানি না কতদূর গেলে এই স্বেচ্ছাপলায়নের সমাপ্তি ঘটবে। 

*****

আমার ঠিক সামনে মাটিতে বসা কুকুরটি দীর্ঘ সময় ধরে ঘেউ ঘেউ করে ডেকেই যাচ্ছিল। আমি বিরক্ত হয়ে হাতে ধরা পাউরুটির অর্ধেকটা ছুঁড়ে দিলাম ওর দিকে। খাবার সময় বিরতিহীনভাবে কুকুরের ডাক শুনতে কারো ভালো লাগে? পাউরুটি পেয়ে সে গোগ্রাসে গিলতে শুরু করল ওটা। স্বভাবসিদ্ধ কৌতুহলের বশে আমি কুকুরটার দিকে ভালো করে তাকালাম। 

নাকের দিকটা এবরো থেবরো হয়ে আছে। দেখে মনে হয় কোন আঘাত পেয়ে এই অবস্থা হয়েছে। ওদিকে পেছনের দিকে বাম পা’টি একেবারেই নেই। কেটে বাদ দেয়া হয়েছে। স্ট্র্যাপ দিয়ে একটা হুইল চেয়ার লাগানো সেখানে।  ওটা দিয়েই চলাফেরা সম্পন্ন করছে সে। নিশ্চিতভাবেই কোন সহৃদয়বান ভেট সার্জন এই সার্জারিটা করে দিয়েছে। কুকুরটার এমন করুণ দশা দেখে মায়া হলো ভীষণ। আরেকটা পাউরুটি কিনে ওকে খেতে দিয়ে বললাম, 
“তুই তো বিশাল পুংটা আছিস রে। এত তাফালিং করিস কেন? নাক-পা তো এই করেই গেলো বলে মনে হচ্ছে!”
 
কুকুরটা মুখ তুলল। দেখলাম ওর দুই চোখের কোনে জল। কুঁই কুঁই করে কিছু একটা বলল আমাকে। তার গলার স্বর এবার আগের থেকে ক্ষীণ। কী বলল বুঝতে পারলাম না। অবশ্য আমার বোঝার কথাও না। সৃষ্টিজগতের আশরাফুল মাখলুকাত হয়েও প্রাণীর ভাষা বোঝার মত বুদ্ধিমত্তা আমার নেই। আমি বাড়ির পথ ধরলাম। সন্ধ্যে নেমে এসেছে।