পোস্টস

প্রবন্ধ

ন্যানো ফিকশন কী? কীভাবে লিখতে হয়?

২০ এপ্রিল ২০২৪

সজল চৌধুরী

মূল লেখক সজল চৌধুরী

ন্যানো ফিকশন (Nano Fiction) হচ্ছে কাঁটায় কাঁটায় ৫৫ শব্দের পূর্ণাঙ্গ গল্প। ৫৫ শব্দের কম বা বেশি হলে হবে না। আবার আংশিক বা অসম্পূর্ণ গল্প হলেও হবে না। এটি মাইক্রো ফিকশন বা খুদে কথাসাহিত্যের একটি বিশেষ শাখা। একইভাবে ড্রিবল (Dribble) ফিকশন হচ্ছে ৫০ শব্দের ও ড্রাবল (Drabble) ফিকশন হচ্ছে ১০০ শব্দের মাইক্রো ফিকশন।

ছোটোগল্পের মতোই এতে চারটি উপাদানের উপস্থিতি অত্যাবশ্যক।

কাঠামো (Setting)—গল্পটা কোথাও না কোথাও ঘটতেই হবে। হতে পারে সেটা আপনার চিন্তায়, কোনো বনে, আপনার প্রতিবেশীর বাড়িতে, আপনার বাগানে, যে-কোনো খানে।

এক অথবা একাধিক চরিত্র (Character)—অবশ্যই এক বা একাধিক চরিত্র থাকবে। চরিত্রে কোনো বাঁধাধরা নেই। মানুষ, পশুপাখি, জড়বস্তু যে-কোনো কিছুই হতে পারে।

দ্বন্দ্ব (Conflict)—কোনো ঘটনার সাথে যুক্ত থাকতে হবে (involvinyg an event)। সেটা হতে পারে যুদ্ধ, ধাওয়া, চক্রান্ত, এমনকি নীরবতা।

সিদ্ধান্ত (Resolution)—গল্পের একটি সমাপ্তি থাকবে যাতে গল্পে উত্থাপিত দ্বন্দ্বের যথার্থ, যৌক্তিক সমাধান থাকবে। 

ড্রাবল/ন্যানো/ড্রিবল ফিকশনে শব্দ গণনা

১. যতি চিহ্ন (! “ ‘ : ; / ?।) শব্দ হিসেবে গণনা হবে না।

২. সংখ্যা অংকে (১, ২, ৩৫, ৬৯৯) লিখলেও শব্দ হিসেবে গণনা করা হবে। এক্ষেত্রে ১২০ একটি শব্দ কিন্তু একশ বিশ দুই শব্দ। তাই সংখ্যার সদ্ব্যবহার করুন।

৩. উদ্ধরণ (‘) চিহ্ন ব্যবহার করলে সেটা এক শব্দ হিসেবে গণনা করা হবে। যেমন: “দুই বার” দুটি শব্দ কিন্তু “দু‘বার” একটা শব্দ। তাই এটার সদ্ব্যবহার করুন।

৪. হাইফেন (-) যুক্ত শব্দ পৃথকভাবেই গণনা করা হবে। মানে ভাই-বোন, পিতা-মাতা দুই শব্দ হিসেবে গণনা করা হবে।

৫. আব্রোভিয়েশন পৃথক পৃথক শব্দ হিসেবে গণনা হবে। যেমন: আ আ ম স আরেফিন সিদ্দিক কিংবা মি. বাদল। এখানে আ আ ম স বা মি. যদিও আব্রোভিয়েশন তবুও এগুলো পৃথক পৃথক শব্দ।

(এতকিছু মনে না রাখলেও হবে যদি অ্যান্ড্রোয়েড সেট অথবা কম্পিউটার থাকে। Microsoft Office Word এ লিখলে কত শব্দ লেখা হয়েছে সেটা সেখানে সহজেই দেখা যায়। অ্যান্ড্রোয়েডের জন্য Word Counter ব্যবহার করতে পারেন।)

✦ আর হ্যাঁ, যদিও গল্পের শিরোনাম ১০০/৫৫/৫০ শব্দের মধ্যে হিসাব হবে না, তবে এটি সাত শব্দের বেশি হবে না।

কীভাবে মাইক্রো ফিকশন লিখবেন

✍ মাইক্রো ফিকশন বা খুদে কথাসাহিত্য হচ্ছে বড়ো পাথর কেটে ছোটো ভাস্কর্য তৈরি করার মতো।

✍ ১০০/৫৫/৫০ শব্দের হিসাব শুরু থেকে করবেন না। ইচ্ছামতো দৈর্ঘ্যে লিখুন। তারপর ভাস্কর্য তৈরি করার মতো বড়ো লেখাকে ছোটো করতে থাকুন।

✍ প্রথম কাজটা হচ্ছে ছোট্ট একটা প্লট দাঁড় করানো। বড়ো প্লট মানেই বড়ো দৈর্ঘ্যের গল্প। তাই প্লট যত ছোটো, গল্পকে ১০০/৫৫/৫০ শব্দে আনা ততই সহজ।

✍ প্লট ভাবা হয়ে গেলে দ্বন্দ্ব নিয়ে ভাবুন। গল্পে কী টুইস্ট বা চমকটা দেবেন তা ঠিক করে ফেলুন।

✍ এবার চরিত্রগুলো নিয়ে ভাবুন। চরিত্রকে যত অল্প দাগে আঁকতে পারবেন ততই ভালো। বয়স, আকার, মুখ, চোখ, কান এতসবের বর্ণনা একদমই প্রয়োজন নেই। কাঁচাপাকা, মধ্যবয়স, ষোড়শী, দোহারা, সুঠাম ইত্যাদি বিশেষণে কাজ চালান।

✍ খুব ভালো হয় নাম এড়িয়ে সর্বনাম ব্যবহার করলে। যেমন: যদি লেখেন, “শফিক সাহেবই হত্যাটা করেছেন।” এখানে লেগেছে ৪ শব্দ। এটা লিখতে পারেন, “তিনিই হত্যাটা করেছেন।” এতে একটা শব্দ বেঁচে গেল।

✍ চরিত্রের পর আসবে কাঠামো। স্থানের কথা অবশ্যই উল্লেখ করতে হবে। রুমটায় মুখোমুখি চেয়ারে বসে আছি; প্লেনটা বিস্ফোরিত হতে যাচ্ছে; অফিসে অলস সময় কাটাচ্ছি। এভাবেই স্থান বা অবস্থানের কথা তুলে ধরবেন।

✍ সবশেষে আসবে সমাপ্তি। দ্বন্দ্বের সমাধান। ধরুন, গল্পে লিখেছেন দুইজন ডুয়েল লড়বে মানে মুখোমুখি বন্দুক যুদ্ধে লিপ্ত হবে। এই সংঘর্ষ বা দ্বন্দ্বের যথার্থ সমাপ্তি হতে পারে, দুজনের কেউ মারা যাবে। কিন্তু দুজন লড়তে লড়তেই গল্প শেষ হলে সেটা যথার্থ সমাপ্তি হবে না। যদি গল্পে ২+২ লেখেন তবে গল্পের সমাপ্তিতে অবশ্যই=৪-ই লিখতে হবে। ৩ বা ৫ লিখতে হবে না। সুতরাং এই বিষয়টা খেয়াল রাখবেন।

বাংলায় আমার লেখা একটা মাইক্রো ফিকশন

ন্যানো ফিকশন : তারা

মধুচন্দ্রিমায় এসে বাংলোয় ওঠার কিছুদিন পর রেজওয়ানা খেয়াল করলো তার স্বামী প্রতি রাতে তারা দেখে।

একদিন কৌতূহলী জিজ্ঞাসা করলো, “প্রতিদিন তারা কেন দেখো?”
“সে দেখতে বলেছিল বলে।”
“সে এখন কোথায়?”
“তাকেই তো দেখি।”
“তাকে খুব ভালোবাসতে?”
“ঠিক তা নয়। আমি আমার শিকারদের সবসময় মনে রাখি।”
এরপর চাকু রক্তাক্ত হয়। আর আকাশে যোগ হয় আরেকটি তারা।

(১২/০৪/১৬)

✍ এই গল্প বিশ্লেষণ করে দেখি, চারটা উপাদানই আছে কিনা—

➔ কাঠামো (Setting)—গল্পটা ঘটেছে একটা স্থানে। স্থানটি হলো বাংলো। যেখানে গল্পের কাঠামো গড়ে উঠেছে।

➔ এক অথবা একাধিক চরিত্র (Character)—গল্পে দুইটি চরিত্র রয়েছে। ঘাতক ও তার স্ত্রী রেজওয়ানা।

➔ দ্বন্দ্ব (Conflict)—দ্বন্দ্বটা হচ্ছে, রেজওয়ানার কৌতূহল। তার জামাইয়ের অদ্ভুত আচরণ তাকে দ্বন্দ্বে ফেলে দিয়েছে।

➔ সিদ্ধান্ত (Resolution)—রেজওয়ানার কৌতূহল মেটে তার স্বামীর স্বরূপ উন্মোচিত হবার মাধ্যমে। আর দ্বন্দ্বটিরও সমাধান পাওয়া যায়, যা গল্পকে যথার্থ সমাপ্তি দেয়।

মাথায় গেঁথে নেবেন, মাইক্রো ফিকশন মানে ক্ষুদ্র গল্প, তারমানে এই নয় যে এটি আকারে ক্ষুদ্র কোনো চারাগাছ, যার ফুল-ফল জন্মানোর সামর্থ্য এখনও হয়নি।

এটি বনসাই—যা পূর্ণাঙ্গ বৃক্ষ। যার ফুল-ফল জন্মানোর সামর্থ্য রয়েছে। কিন্তু আকারে সে ক্ষুদ্র। আর একে নান্দনিক ও আকর্ষণীয় বানানো আপনার দক্ষতার ওপর নির্ভর করবে।

আর হ্যাঁ, আইডিয়া এলেই তাড়াহুড়ো করে নয়, সময় নিয়ে লিখুন। ঘষামাজা করুন। গল্পরা প্রাথমিক অবস্থায় থাকে খনিতে পাওয়া হীরার মতো মতো। যার সাথে পাথরের তফাৎ খুব কম থাকে। একে ধীরেধীরে কেটে, যত্ন নিয়ে ঘষে ঘষে পরিষ্কার করার মাধ্যমেই এর আসল সৌন্দর্য উন্মোচিত হয় সবার মধ্যে।

মাইক্রো ফিকশনের আরও উদাহরণ পড়তে চাইলে সংগ্রহ করতে পারেন আমার বই “এক পাতার গল্প”।