পোস্টস

গল্প

মহাকালের দেয়াল

২০ এপ্রিল ২০২৪

সায়হাম রহমান শান্ত

মূল লেখক সায়হাম রহমান শান্ত

শরতের বিকেল। 
ঘড়িতে ৫টা বেজে ৪০।


চারিদিকে একটা আবছা শীতল বাতাস, আকাশে সাদা মেঘের ভেলা, শাড়ি-পাঞ্জাবি পরে আসা একঢল রমণী ও সুদর্শন যুবকদের ভীড়। সবমিলিয়ে টিএসসি চত্বরের প্রকৃতি এখন এক মায়াবী রূপ ধারণ করেছে। এদের মধ্যেই সাদা-লাল কম্বিনেশনের একটা চমৎকার শাড়ি পরে আসা একটা মেয়েকে দেখা গেলো। মেয়েটার নামটা অদ্ভুত; সুহাসিনী সরকার মিথেন। তার মা ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের চারুকলা বিভাগের সহকারী অধ্যাপক, অনেক বড় একজন রবীন্দ্রভক্ত। কবিগুরুর একটি বিখ্যাত ছোটগল্প থেকে তাই খুব শখ করে মেয়ের নাম রেখেছিলেন সুহাসিনী। আর তার বাবা জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়ের রসায়ন বিভাগের অধ্যাপক। সুহাসিনী তাঁর প্রথম ও একমাত্র মেয়ে হওয়ার কারণে তার নাম রেখে দেন মিথেন। মা তাকে আদর করে ডাকেন সুহা, আর বাবা আদর করে ডাকেন মিথি। 


আপাতত এই সুহা ওরফে মিথি তার হবু স্বামী, রিফাতকে ফোন দিচ্ছে। কিন্তু, রিফাত ফোন ধরছে না। রিফাত অবশ্য সবসময়ই এমন করে। তাকে কিছুটা অবহেলা করে। তাদের সম্পর্কের আজ ৬ বছর। কিছুদিন আগেই তারা দুজনে নিজেদের বাসায় নিজেদের সম্পর্কের কথা বলেছে এবং দুই পরিবারই বিয়েতে সম্মতি জানায়। আগামী মাসের তেইশে তাদের বিয়ে। ক্লাস নাইনে থাকা অবস্থাতেই সুহা রিফাতের প্রেমে পরে।তাদের স্কুলের কলেজ শাখায় তখন ইন্টার সেকেন্ড ইয়ারে পড়তো রিফাত। তবে ক্লাস নাইনে প্রেমে পড়লেও সেটা রিফাতকে জানায় তার এসএসসি পরীক্ষা দেয়ার পর। রিফাতের সাথে ফেসবুকে অনেক আগে থেকেই অ্যাড থাকায়, এই কথা জানাতে তেমন একটা বেগ পেতে হয়নি সুহাকে। রিফাত কিছুটা সময় চায় প্রত্যুত্তরে এবং পরে তারা একটা সম্পর্কে চলে যায়। তবে রিফাত সবসময় নিজেকে বড় আর সুহাকে ছোট করে দেখে; কথা আর কাজে তা-ই বোঝানোর চেষ্টা করে। তবে সুহা এতে কিছু মনে করেনা। সে তার চিরসুখের ভালোবাসাকে হারাতে চায় না। রিফাত এখন একটা প্রাইভেট ফার্মে খুব ভালো একটা চাকরি করে। তার আছে বিলাসবহুল বাড়ি, গাড়ি আর যেসব জিনিস একজন বিলাসবহুল মানুষের প্রয়োজন হয়, সে সবকিছু।   
সুহা আবারও কল দিলো, রিং হচ্ছে কিন্তু, কল রিসিভ করছেনা। এই নিয়ে ছ’বার কল দিল সুহা, কিন্তু, রিফাতের কাছ থেকে একটা রিপ্লাই পর্যন্ত আসেনি। 


হাতঘড়িতে এখন ৬টা বাজে, অথচ রিফাতের এখানে থাকার কথা ৫টা বাজে। সুহা এবার সিদ্ধান্ত নিলো, সে চলে যাবে। আসার সময় তার মন খানিকটা খারাপ। ৬টা বছর হলো সম্পর্কের, এখনো তার প্রিয় মানুষ তাকে কেন অবহেলা করে, সেটা তার জানা নেই।
কয়েক কদম চলার পর তার কানে একটা সুর বেজে উঠল। কে যেন একটা অ্যাকোস্টিক খুব ভালো করে বাজাচ্ছে। আর এই সুরটা এর আগে সে কখনো শুনেনি। অনেক ইউনিক। সাধারণত সুহার যখন মন খারাপ থাকে তখন সে কোনো গান-টান শুনেনা, কারো সংস্পর্শে থাকে না, সম্পূর্ণরূপে সে একা থাকতে চায়। একাই সে নিজের দুঃখ নিয়ে বড় বড় অট্টালিকার সমান দুঃখবিলাস বানায়। কিন্তু, আজ তার এই সুরটা শুনে অনেক ভালো লাগছে। সে সুরের ভেলাটা কোথা থেকে আসছে সেটা দেখার জন্যে এগিয়ে গেল। এগিয়ে গিয়ে দেখল একটা লাল রঙের পাঞ্জাবী’অলা একটা ছেলে অ্যাকোস্টিক বাজাচ্ছে। ছেলেটার চেহারার রঙ শ্যামল বর্ণের, চুলগুলো কাঁধ পর্যন্ত লম্বা, চোখগুলো মাঝারি ধরনের, হালকা দাড়ি, হালকা গোঁফ, মুখে হাসি ওঠানামা করছে। সুহার সুরগুলো শুনে মনে হচ্ছে এতো সুন্দর গানের সুর সে কখনো শুনেনি। ছেলেটার আশেপাশে কিছু আগ্রহী শ্রোতার আগমন দেখা গেলো। সে কিছুটা দূরত্ব রেখে ছেলেটার পাশে বসলো। ছেলেটা বাজাচ্ছে, আর সে মনোযোগ দিয়ে শুনছে। ছেলেটা গাইছেঃ


“এই আলো ধরে রাখো, কুঠুরি।
আমাকে আর খুঁজো না। 
আমি থাকব নিভে যাওয়া প্রদীপের আঁধারে...
এই গান শুনে রাখো বালুতীর।
আমাকে আর ডেকো না।
আমি চলে যাব চিলের ডানায় গভীর সাগরে...
মানুষের হৃদয় ভরে ওঠে আবার শূন্য হওয়ার জন্য।
বিস্তৃতির এই ফুলেল বাগানে ঝরা ফুলে মধু খুঁজে ভ্রমর হয় ধন্য..."


গান গাওয়া শেষে ছেলেটি সুহার দিকে তাকাল।
সুহা বলল, 
“আমি সুহা। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে বোটানি বিষয়ে পড়ছি। আপনার সাথে কি পরিচিত হতে পারি?” 
ছেলেটি এক দৃষ্টিতে সুহার দিকেই তাকিয়ে আছে। দুটি ডাগর ডাগর মায়াবী চোখ, মাথায় একগোছা চুল, কানে দুল। তার চোখ থেকে এতটাই মায়া নিঃসৃত হচ্ছে যে পরিবেশের অন্যান্য উপাদান কারো চোখে পড়ার সম্ভাবনাই নেই। হাজারো চেষ্টা করেও ছেলেটি তার চোখ সুহার চোখ থেকে সরাতে পারছেনা। সুহাও বুঝতে পারছেনা কেন ছেলেটি অপলক দৃষ্টিতে তার দিকেই চেয়ে আছে। 
সুহা বলে উঠল, 
- এই যে স্যার! আপনাকেই বলছি। 
এবার ছেলেটি কিছুটা লজ্জা পেল, বলে উঠল,
- আমি সৌরভ। পড়ালেখা শেষ করেছি গতবছর জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয় থেকে। মনোবিজ্ঞান বিষয়ে। এখন বাবার ব্যবসা দেখছি।
- তা অমন হা করে কী দেখছিলেন আমার চোখের দিকে? 
- কখনো এতো সুন্দর দেবী দেখার সুযোগ হয়নি তো, তাই।
- (কিছুটা হেসে উড়িয়ে দিয়ে) কী যে বলেন না। আমি একটুও সুন্দর না। শ্যামলা একটা মেয়ে। যাক্‌ গে সেসব। তা খুব ভালো গান করেন দেখছি। (মিষ্টি হেসে) আপনার উনিকে দেখছি না যে? সে কোথায়? 
এবার সৌরভ হা হা করে হেসে দিলো। সুহার মনে হল এরকম প্রাণবন্ত হাসি সে শেষ কবে দেখেছে তার মনে নেই। সৌরভ এবার হাসি থামিয়ে বলল,
- (গিটারের তারে হাত বুলাতে বুলাতে) আমার কোনো উনি নেই। আমার চিন্তাভাবনা একটু ব্যাকডেটেড তো, তাই তেমন কোনো মেয়ে আমাকে পছন্দ করেনা। আর কে বলেছে মোনালিসা সুন্দর আর আপনি সুন্দর না? হ্যাঁ, এটা অভিজাত ব্যবসায়ী আর তাদের চ্যালাপ্যালারা আপনাকে বলবে। কারণ এসব কথা বলে তারা আপনাকে হীনমন্য করতে চায় আর আপনার এই হীনমন্যতাকে কাজে লাগিয়ে ব্যবসা করতে চায়। স্রষ্টার সব সৃষ্টিই সুন্দর। সৌন্দর্যকে শুধু এই শর্তে মেনে নিতে রাজি আছি। আর বিশ্বাস করুন, আপনার মতো মায়াবতী আমি এর আগে কখনো দেখিনি। সৌন্দর্যবতী হিসেবে আপনি না স্বীকার করলেও, মায়াবতী হিসেবে নিজেকে আপনি অস্বীকার করতে পারবেন না-এতে আমি বাজি ধরলাম। 

এবার সৌরভের কথা শুনে সুহা কিছুটা অবাক হলো। তাকে এই প্রথম কেউ এতো সুন্দর বলেছে, তাও আবার উপযুক্ত ব্যাখ্যা সহ। রিফাত তাকে কোনোদিন এভাবে বলেছে বলে তার মনে পড়ে না। পৃথিবীতে এখনো এরকম মানুষ আছে, সেটা সুহার জানা ছিলো না। সুহা একটু মুচকি হাসি দিয়ে বললো, 
- প্রতিদিনই কি এখানে আসেন নাকি? 
পাশেই এক মামা হাতে ফ্লাস্ক নিয়ে চা বিক্রি করছিলেন। কথাটা তাঁরও কানে গেলোঃ 
- হ, মা। ভাইগ্না তো এই জায়গায় ডেইলিই আহে।
সৌরভ বললো,
-হ্যাঁ, আসলে বাসায় বদ্ধ থাকতে তেমন ভাল্লাগেনা। তাই এখানে খোলা প্রকৃতিতে একটু আসা আর কি। তা যার জন্যে সেজে এসেছেন সে কই? তাকে দেখছিনা যে? 
- (মাথাটা নিচু করে) সে ব্যস্ত আছে। তাই ফোন ধরছেনা।


হঠাৎ সুহার ফোন বেজে উঠল। সুহা দেখল বাসা থেকে মা কল দিয়েছে। সে ফোন রিসিভ করল।
- হ্যালো, সুহা। কই তুই? সন্ধ্যা হয়ে গেছে তো। বাসায় আসতে মন চায়না নাকি?
- হ্যাঁ, মা। আসছি আমি। ২০ মিনিটের মধ্যে এসে পড়বো।
- তাড়াতাড়ি আয়।


তারপর সুহা কল কেটে দিলো। সুহা ফোনের ঘড়ির দিকে চেয়ে দেখল প্রায় ৭টা বেজে গেছে। 
- আজ তাহলে আসি। আবার দেখা হবে।
- আচ্ছা। ওরভোয়া। 
- (থতমত খেয়ে) কী বললেন? 
- (ফিক করে হেসে) ওরভোয়া। একটা ফরাসি শব্দ। অর্থ, “আবার দেখা হবে।”


মুচকি হেসে বিদায় নিয়ে তারপর সুহা টিএসসি থেকে একটা রিকশা নিলো। তার বাসা ধানমন্ডি ভূতের গলিতে। সুহা বাসায় আসার পর ফ্রেশ হলো। আজ সে মোটামুটি আনন্দিত। এই জীবনে তাকে কেউ কখনো এতো সুন্দর বলেনি। অন্যদিনের মতো আজ সে ডিনার লেট করে করল না। বাবা-মার সাথে বসেই ডিনার করল। তাঁরা আজ কিছুটা অবাক। কারণ, সুহা অনেক দেরি করে ডিনার করে। ডিনার শেষ করে সে তার টেবিলে বসেছে। আজকে সে তার ডায়েরিতে লিখে রাখবে সবকিছু। চেয়ারে বসার পরমুহূর্তেই রিফাতের কল আসলো। একবার সুহা ভাবল আজকে সে কিছুতেই রিফাতের ফোন ধরবেনা। পরক্ষণেই আবার ভাবলো, হাজার হোক, রিফাত তার ভালোবাসা। এতকিছু ভেবে সে কলটা ধরল। ফোন ধরার পরই রিফাত ঐ পাশ থেকে বলে উঠলো,
- হ্যালো, সুহা। কেমন ছো তুমি?
- আলহাম্‌দুলিল্লাহ, ভালো। তুমি?
- হ্যাঁ, ভালোই। (হঠাৎ রাগত স্বরে) আচ্ছা, তোমার কি মিনিমাম কমন সেন্সটুকুও নাই?"
- কেন? কী হয়েছে?
- আমি কল কেটে দেয়ার মানেই ছিল আমি ব্যস্ত আছি। তাও তুমি বেকুবের মতো বারবার কল দিচ্ছই তো দিচ্ছ। তুমি কি কিছুই বুঝোনা?"
- আচ্ছা, সরি। আমি বুঝতে পারিনি।
- এটা বোঝা দরকার তোমার। এইটা তো আর ইউনিভার্সিটি লাইফ না, যে হেসেখেলে যখন ইচ্ছা ফ্রি থাকব। এই সময়টা ক্যারিয়ার গড়বার সময়, অফিসে কাজও থাকে অনেক...
- আচ্ছা, সরি বললাম। 
- It’s ok। আমিও সরি। আজকে মিটিং ছিল তাই আসতে পারিনি। তুমি কাল দুপুরে ‘The Buffet Stories’ তে এসো। কাল আমরা একসাথে লাঞ্চ করব। আর হ্যাঁ, তোমার গত জন্মদিনে যেই ডায়মন্ড রিংটা গিফট দিয়েছিলাম, সেটা পরে আসবে।
- সত্যি। অবশ্যই আসবো। ভালোবাসি তোমাকে! (এই কথা বলে সুহা কান্না করে দিল)
- আরে কান্না করার কী আছে? আমিও ভালোবাসি তোমাকে। আচ্ছা, আমি এখন ডিনার করব। পরে কল দিব তোমাকে!
- আচ্ছা।
রিফাত কল কেটে দিলো।
সুহা তার ডায়েরিতে লিখলোঃ
আজ সৌরভের সাথে আমার প্রথম পরিচয়। ছেলেটা দেখতে খুব একটা সুদর্শন না। কিন্তু, ছেলেটার মন ভালো মনে হয়েছে। আমার খুব প্রশংসা করেছে। আপাতদৃষ্টিতে, এটা ফ্লার্টিং মনে হতে পারে। কিন্তু, ছেলেটার ভাব-ভঙ্গি দেখে ফ্লার্টিং মনে হলো না। ছেলেটার গিটারের সুর আমার সব দুঃখ এক মুহূর্তেই মুছে দিলো। কোনো একটা জাদু হয়তোবা ঐ গিটারে আছে অথবা ছেলেটার হাতে আছে। কী জানি। তবে ছেলেটাকে একটা ভালো মনের মানুষ মনে হয়েছে। বন্ধুত্ব করাই যায়।


এটুকু লিখে সুহা ঘুমিয়ে পড়ার প্রস্তুতি নিলো। সে শুয়ে পড়ার সাথে সাথেই আজ ঘুমিয়ে গেল। 


অন্যদিকে, সৌরভও সেসময়ে বাড়ি ফিরে এসেছে। তার বাড়ি চানখারপুল। টিএসসি থেকে একদমই কাছে। বাসায় এসেও যেন সে সুহার সৌন্দর্যের ঘোর থেকে বের হতে পারছেনা। এত সুন্দর একটা মেয়ে হতে পারে-সেটা সৌরভ আগে জানত না। বাসায় আসার পরই তার মা প্রতিদিনকার মতো চোখ বড় বড় করে বলে উঠলেন,
- তা কবি সাহেব, বাসায় ফেরার কথা মনে পড়ল বুঝি? টিএসসিতে সাথে করে কাঁথা-বালিশ নিয়ে গেলেই পারেন। বাসায় আর কষ্ট করে আসতে হয়না।
- আরে মা, ঘরে ভাল্লাগেনা একা একা। তুমি তোমার কাজে ব্যস্ত থাক, বাবা বই পড়ে, ভাইয়া চইলা যায় ব্যবসায়, ভাবি তোমার কাজে সাহায্য করে। যাই হোক, ক্ষুধা লাগসে, ভাত দাও।
- বয়স তো হইছে, বাবা। এবার বিয়ে-শাদি করো। তোমার কোনো প্রেমিকা থাকলে বলো। বিয়ে করিয়ে দিই।
- নরকের কবির কোনো প্রেমিকা হয় না, মা।
সাথে সাথে তার মা তাকে একটা কানমলা দিয়ে বললেন,
- ওরে আমার নরকের কবি রে! মেরে একেবারে তক্তা বানায়ে দিব। কবি গিরি বাদ দিয়ে হাতমুখ ধুয়ে আয়, আমি ভাত বাড়ছি।
সৌরভ এবার ওয়াশরুমে গেল ফ্রেশ হতে। সে যথারীতি ফ্রেশ হয়ে ডাইনিং টেবিলে এসে খেতে বসল। তার খাওয়া শেষে তার মা কিছুটা ব্যঙ্গ করে বলল, 
- কবি সাহেব, আর কয়েক মাস সময় দিলাম। আপনার কোনো মেয়ে পছন্দ হয় কিনা দেখেন। নাহলে আমার যে মেয়ে পছন্দ তার সাথেই বিয়ে দিয়ে দিব আপনাকে। তখন কিছু বলতে পারবেন না। 
- মা, ভাবতেসি বিয়েই করব না। জীবন সুন্দর।  
- দাঁড়ান কবি, আপনাকে দেবদাস বানাচ্ছি। 
এই কথা বলে তার মা হাতে থাকা তরকারির চামচ দিয়ে তাকে দৌড়ানি দিল। দৌড়ানিটা অবশ্য সৌরভ ভালোই এঞ্জয় করল। তার মাকে প্রতিদিন এমন একবার না রাগাতে পারলে তার পেটের ভাত হজম হয় না।


খাওয়া-দাওয়া শেষে সৌরভ নিজের রুমে ফিরে আসল। আজকে সে আর কোনো কাজ করবেনা, একদম ডিরেক্ট ঘুম। কারণ সকালে আবার অফিসে যেতে হবে, ব্যবসার কী হালচাল বুঝতে হবে। যেই ভাবা, সেই কাজ। সে লাইট অফ করে ঘুমিয়ে পড়ল। 
রাত বাজে দুইটা।


হঠাৎ একটা স্বপ্ন দেখে সৌরভের ঘুম ভেঙে গেল। স্বপ্নে সে সুহাকে দেখতে পেল। এটা হওয়া প্রায় অসম্ভব ছিল। কারণ, সৌরভ গভীর ঘুমের মানুষ। গভীর ঘুমের মানুষেরা স্বপ্ন দেখেনা। সেও প্রায় মাস খানেক ধরেই স্বপ্ন দেখেনি। মানুষের ঘুম একেবারে হালকা হলে, তবেই মানুষ স্বপ্ন দেখে। যাই হোক, তবে সৌরভের স্বপ্ন দেখে ভালোই লেগেছে। একটা অনুপমাকে স্বপ্নে দেখা মুখের কথা না। স্বপ্নে দেখার একটা সুবিধার কথা মনে পড়ে সৌরভ কিছুক্ষণ হাসল। সুবিধাটা এরকম- যদি তাকে বাস্তবে দেখতে পেতো, তাহলে কখনো এক দৃষ্টিতে এতোক্ষণ তাকিয়ে থাকতে পারতো না। কারণ, সুহা বাধা দিত অথবা লোকলজ্জার কারণেও সেটা প্রায় অসম্ভব ছিল। স্বপ্নে দেখায় এরকম কোনো বাধা পেতে হয়নি তাকে। তবে সে এতটুকু তো নিশ্চিত যে, সে সুহার প্রেমে পড়ে গেছে। হঠাৎ তার ‘আনমনে’ গানের কয়েকটা লাইন গাইতে মন চাইল। বাইরে রাতের শীতল মৃদুমন্দ বাতাস, চারিদিকে নিশ্চুপ আঁধার। কোথাও কোনো শব্দ নেই, কোলাহল নেই। এক কথায় প্রকৃতিও দারুন একটা রূপ ধারণ করে আছে। সে গাওয়া শুরু করলঃ
“জানি এই রাতশেষে, ফিরবেনা তুমি আর।
তবুও কেন যে আসে, ঘুমের মাঝে তোমার ছবি।
কল্পনাতে কেন যে তোমার হাসি শুনি।”
গান শেষে গিটারটা রেখে আবার ঘুমিয়ে পড়ল।


পরদিন সকাল। 
নাস্তা করেই সুহা সাজগোজ শুরু কলো। সে আজ মহাখুশি। কারণ, তার মনে হচ্ছে আজকে রিফাত আসবেই। সাজগোজ করতে গিয়ে একসময় তার মনে হলো রিফাতের দেয়া ইয়ার রিং এর কথা। সেটাও তো খুঁজতে হবে। সে সবকিছু বাদ দিয়ে সেটা খোঁজা শুরু করলো। ১ ঘন্টা হলো, ২ ঘন্টা গেলো, কিন্তু, ইয়ার রিংজোড়া আর খুঁজে পাওয়া যাচ্ছেনা। তারপর হঠাৎ তার মনে পরলো সেটা কিছুদিন আগেই চুরি হয়ে গেছে তার কান থেকে। সে কিছু না বুঝতেই তার কান থেকে টান দিয়ে নিয়ে গেছে। সে ভাবছে রিফাত আবার এটার জন্য তাকে বকাবকি করবে না তো। আবার সে নিজেই ভাবছে রিফাত হয়তোবা ব্যাপারটা বুঝবে। এরকম হাজারো ধরনের চিন্তাভাবনা করে সুহা ‘The Buffet Stories’ তে গেলো। তখন দুপুর একটা বাজে।


সুহা তার পছন্দমতো একটা টেবিলে গিয়ে বসল। তারপর রিফাতকে কল দিল। রিফাত এবার কল রিসিভ করল। তাদের কথোপকথনটা হলো এরকমঃ
- হ্যালো, রিফাত। কোথায় তুমি?
- আমার আসতে আর ২ মিনিট লাগবে।
- আচ্ছা, তাড়াতাড়ি আসো। খুব মিস করছি তোমায়।
- আচ্ছা, আসতেছি।
৫ মিনিটের মধ্যেই রিফাত এসে হাজির হলো। তারা প্রথমে উভয়কে হালকা জড়িয়ে ধরল। তারপর বসে সাধারণ আলাপচারিতায় মগ্ন হলো। 
হঠাৎ এই কথাবার্তার মাঝেই রিফাতের নজরে পরে সুহা তার দেয়া ইয়ার রিংজোড়া সে পরে আসেনি। তারপর সে বললো,
- সুহা, এটা কি আমায় অপমান করা হলো না? আমি যেই ইয়ার রিংটা দিয়েছিলাম, সেটা পরে আসলেনা।
- সরি, রিফাত। আমি একদিন রিকশা করে বাসায় আসছিলাম। তখন এক ছিনতাইকারী টান দিয়ে আমার কান থেকে ইয়ার রিং জোড়া নিয়ে যায়। আমার কান থেকে রক্তও পড়ছিলো। ব্যান্ডেজ করেছিলাম। 
রিফাত তার ক্রোধকে সংবরণ করতে পারলো না। 
- কী!!! ছিনতাইকারী টান দিয়ে নিয়ে গেছে? তুমি ইয়ার রিং জোড়ার দাম জানো? পুরোটা ডায়মন্ডের ছিলো। তুমি এই দাম কোনোদিন শোধ করতে পারবে? পারবে না তো। আসলে তুমি সেটার যোগ্যই ছিলেনা। রাবিশ কোথাকার।
এসব শুনে সুহা আর তার কান্না আটকাতে পারল না। চোখ দিয়ে তার অঝোর বৃষ্টি পড়তে লাগলো। কিন্তু, রিফাত তার কান্না না থামিয়ে, তাকে বলে উঠল, 
- হইছে,হইছে। এবার ন্যাকা কান্না থামাও। কান্না থামিয়ে খেয়ে নাও। নাইলে আমার টাকাগুলা জলে যাবে।
এবার সুহা আর সহ্য করতে পারল না। সে চোখ মুছে, তার হ্যান্ডব্যাগ নিয়ে এক দৌড়ে রেস্টুরেন্ট থেকে বের হয়ে গেলো। একটা মানুষ যাকে সে নিজের থেকেও বেশি ভালোবাসে, সে কীভাবে তাকে এমনভাবে কথাগুলো বলতে পারল- এটাই সে বুঝেনা। রিফাতের কাছে তার চোখের পানির চাইতে ঐ ক'টা টাকা বেশি হয়ে গেল? এতোকিছু ভাবতে ভাবতে সে একটা রিকশা নিয়ে তার বাসায় চলে গেল। 
বাসায় পৌঁছাবার সাথে সাথেই দেখা হলো প্রথমে দেখা হলো তার মায়ের সাথে।
- (অবাক হয়ে) কীরে, সুহা? এতো তাড়াতাড়ি ফিরে এলি।
- (কান্নাকে সংবরণ করতে করতে) কিছু হয়নি, মা।
সুহা তার রুমের দিকে চলে যেতে উদ্যত হয়। মা পিছন থেকে ডাকলেন।
- আরে, সুহা... দাঁড়া... 
মায়ের কথার প্রত্যুত্তর না দিয়েই সে নিজের রুমে গিয়ে সজোরে দরজা বন্ধ করে দিলো। বাইরে থেকে একটা ছিটকিনি তোলার আওয়াজ হলো।


বিকেলে বারান্দার গ্রীলটা পশ্চিমা সূর্যচুম্বনের প্রতি আসক্ত হয়ে থাকে। সুহার বাবা-মা এই সময়টাতে ঘুমান কিন্তু আজ মাঝের ঘরের সোফাটায় চিন্তা করছেন, কথা বলছেন আর মাঝে মাঝেই সুহাকে ডাকছেন যদিও ভেতর থেকে আওয়াজ আসছে না। তাঁরা এটুকু আন্দাজ করতে পেরেছেন যে রিফাতের সাথে সুহার কিছু একটা হয়েছে। নাহলে যে মেয়েটা এতো আনন্দ নিয়ে বাসা থেকে বের হলো, সে মেয়েটা এখনো কেন দরজা লক করে বসে আছে? এদিকে একাকী সুহাও দুঃখ বিলাস গড়তে গড়তে অনেক কিছু ভাবছে। কী করে তার ভালোবাসার মানুষ তার সাথে প্রতিনিয়ত এই ব্যবহার করে সেটা সে বুঝেনা। রিফাত কি আসলেই তাকে ভালোবাসে? এই ছ’বছর কি আসলেই রিফাত তাকে ভালোবেসেছে? এই প্রশ্নগুলো তার ভিতরের সত্তা তাকে জিজ্ঞেস করে। কিন্তু, সুহার কাছে কোনো উত্তরই নেই। চাদরটার ওপর মাঝেমাঝেই ফোঁটায় ফোঁটায় জলের বিন্দু পড়ছে। এই কান্না আসলে কার জন্য? রিফাতের জন্য? নাকি নিজের জন্য? এটাও সে বুঝছেনা। হঠাৎ সুহার ভেতরের বিবেক খানিকটা নাড়া দিয়ে উঠলো। তার মনে হলো,  “কার কারণে মন খারাপ করে বসে থাকবো? যে আমাকে এখনো একটা কল দেয়নি, তার জন্যে? 
হঠাৎ মনে পড়লো টিএসসির ছেলেটার কথা। যদি কালকের ছেলেটা থাকে, আজকেও তাহলে ওর গান শুনেই মন ভালো করা যাবে। সে তড়িঘড়ি করে সাজগোছ করে রুমের দরজা প্রায় ৩ ঘণ্টা পর খুললো, তখন তার বাবা-মা চিন্তিত অবস্থা থেকে রেহাই পেলেন যেন।
- মারে, কী হয়েছে তোর? 
- না, বাবা। কিছুই হয় নি। বাইরে যাচ্ছি। পরে এসে কথা বলবো।
- এই অসময়ে বেরুবি?
- হ্যাঁ, বাবা। আমার কাজ আছে।
তাদেরকে কথা শেষ না করতে দিয়ে সে রওয়ানা হলো আর যথারীতি সে জায়গায় গেলো। হ্যাঁ, সৌরভকে সে জায়গাতেই পাওয়া গেলো।


- আসসালামু আলাইকুম, সৌরভ। কেমন আছেন?
- আরে সুহা,আপনি! কেমন আছেন? আমি ভালো আছি স্রষ্টার দয়ায়।
- আছি আর কি। 
সুহার কথা বলায় আক্ষেপের একটা সুর শোনা গেলো। সৌরভ সেটা বুঝতে পারলো। সৌরভ এবার তার গিটারে সুর তোলা শুরু করলো। আজকের সুরটা গতকালকের থেকে অনেকটা আলাদা। আজকের সুরটা শোনার পর সুহার কপালে যে আক্ষেপের ভাঁজ ছিল, সেটা ঠিক হয়ে যেতে লাগলো। সৌরভ গলা মোটা করে গান ধরলোঃ
“শেকল বন্দী বাঘের মত তুমি ভুলে গেছো তোমার হুংকার?
খাঁচায় রুদ্ধ পাখির মত হারিয়েছো কি শক্তি ডানা মেলাবার?
নোংরা পশুর লোভী চাহনি দেখে নেই ভয় পাবার দরকার।
শরীরের শেষ রক্ত ফোঁটা দিয়ে ছিনিয়ে নাও তোমার অধিকার...
অধিকার...
অন্ধকারে বন্ধ হয়ে আসা নিষেধের তালা হ্যাঁচকা টানে ফেল ভেঙ্গে।
ঘৃণা ছুঁড়ে মারো তাদের মুখে, যারা শ্রদ্ধা দেয়নি তোমায়!
জীবন যুদ্ধে পিছিয়ে আছে যারা,
সময় হলো তাদের উল্লাসে ফেটে পড়ার।
দেয়ালের গায়ে ঠেকে আছে পিঠটা,
তবু সংগ্রাম করে ছিনিয়ে নাও অধিকার...”


গানের লাইনগুলো সুহার একেবারে বুকে গিয়ে বিঁধল। সুহা হঠাৎ অপ্রসঙ্গত বলে উঠল, 
“সৌরভ। আমরা কি বন্ধু হতে পারি?”

সৌরভ কিছুটা অবাক হলেও হাসিমুখে বলল,
- আমরা অবশ্যই ভালো বন্ধু হতে পারি, সুহা। তাছাড়া আপনার মতো সুদর্শনার সাথে বন্ধুত্ব করতে পারা আমার জন্যে সৌভাগ্যের ব্যাপার। 
সুহা এবার কিছুটা অবাক হয়ে ভাবছে, সৌরভ কোনোভাবে কি আঁচ করতে পারলো যে তার মনে খারাপ? আর মন খারাপ বুঝতে পারলেও কেন সৌরভ এমন একটা গান গাইলো, যেটার সাথে তার বর্তমান অবস্থার সামঞ্জস্য আছে? মন খারাপের তো আরো অনেক গান আছে। সৌরভ হঠাৎ জিজ্ঞেস করলো,
- অমন করে কী এতো ভাবছো? মুখে মাছি ঢুকে যাবে তো। তোমার মনে হয় গানটা তেমন পছন্দ হয়নি।
- কে বলেছে পছন্দ হয়নি? আমার গানের লাইনগুলো অনেক পছন্দ হয়েছে। আচ্ছা, একটা প্রশ্ন করবো? তুমি কি কোনোভাবে বুঝতে পারলে আমার আজ মন খারাপ?
- আমি মনোবিজ্ঞানের ছাত্র। একটা সুন্দরীর মনই যদি না-ই বুঝতে পারি, তাহলে আর এই মনোবিজ্ঞানে পড়ে লাভ কী হলো?
এবার দুজনেই একেবারে অট্টহাসি দিয়ে উঠলো। একটা সুদর্শনা হাসলে যে কী ভীষণ সুন্দর দেখায়, সেটা সৌরভ এর আগে কখনো দেখেনি। 
সুহা হঠাৎ বলে উঠলো,
- আমার একটু সমস্যা আছে। আমি ‘তুমি’ করে বলতে কম্ফোর্ট ফিল করিনা, ‘তুই’ করে বললে কোনো সমস্যা হবে?
- আরে না। যা খুশি বলতে পারো। তুই-তোকারি সেরা বন্ধুত্বের পরিচায়ক। 
- আসলেই। তবে চল্‌, এই নতুন বন্ধুত্ব গড়বার উপলক্ষ্যে তাহলে চা খাই (হাসিমুখে)। ঢাকা মেডিকেলের আউটডোরের চা’র চাইতে ভালো চা-ই হয় না। আর, আমি খাওয়াব আজকে। সৌরভও এতে সম্মতিজ্ঞাপন করলো। সৌরভ চা-ওয়ালা মামা কে বলল,
- ও, মামা। দুইটা হালকা লিকারের চা দিও তো। একটা চিনি ছাড়া, আরেকটা... (সুভার দিকে মাথা ফিরিয়ে) অ্যাই, তুই কেমন চিনি খাবি? 
-  অল্প চিনি দিতে বলিস্‌। 
চা-ওয়ালা মামা চা বানাতে ব্যস্ত।


শরতের বিকেলে পরিবেশটা মাতাল হয়ে আছে। মনে হচ্ছে স্বর্গের একটা অংশ ভূমিতে নেমে এসেছে। হঠাৎ কাশফুলের ছোট্ট একটা অংশ বাতাসে উড়ে সুহার মুখে এসে পড়লো। সৌরভের মনে হচ্ছে কোনো সুদর্শনাদেবী দাঁড়িয়ে আছে তার পাশে। চা রেডি। দুজনেই হাতে ওয়ান-টাইম গ্লাস নিয়ে দাঁড়িয়ে আছে, হাসছে, কথা বলছে, চা খাচ্ছে। দুজনের মধ্যে একটা মিল পাওয়া গেলো যে সুহা আর সৌরভ কেউই গরম চা খেতে পারেনা। চা হালকা ঠান্ডা হলে তারপর চুমুক দিতে পারে কোনোমতে। 
চা খাওয়া শেষ হলে, সুহা বললো,
- সন্ধ্যা তো প্রায় হয়ে এলো। আজ তাহলে যাই। দেরি করে গেলে বাসায় চিন্তা করবে।
- তবে একটা রিকশা করে দিই তোকে?
- না, থাক্‌। আমি চলে যেতে পারবো। আচ্ছা, তোর ফেসবুক আইডি আছে?
- হ্যাঁ, আছে। 
- নাম বল তো। 
- ‘নরকের কবি’ লিখে সার্চ দিস, পেয়ে যাবি।
আইডির নাম শুনে সুহা আবার হাসিতে মেতে উঠল। সৌরভ কিছু না বুঝতে পেরে বলল,
- কীরে হাসছিস কেন?
- (হাসি থামিয়ে) তা ‘নরকের কবি’ হ’লি কেমনে? 
- (একটু গলা ঝেড়ে আর আক্ষেপের সুরে) যে ছেলে কলেজ জীবনের দুইটা বছর বাদে, সারাজীবন কম্বাইন্ডে পড়েছে অথচ সেই পড়াশোনার জীবনে কোনো মেয়ের সাথে সরাসরি কথা বলেই নি-সে তো নরকের কবিই বটে।
অকাট্য যুক্তি এবার সুহা আরেকদফা অট্টহাসি দিলো। সৌরভ কিন্তু এতে আনন্দিতই হলো। কারণ সুহাকে হাসাতে পারলে তাকে দেখতে পুরো সৌন্দর্যের দেবীর মতো লাগে। এতো সুন্দর মানুষ সৌরভের আগে কখনো দেখা হয়নি। 
সুহা হাসি থামিয়ে জিজ্ঞেস করল, 
- কীরে? বোকার মতো তাকিয়ে আছিস কেন?
- একটা জলজ্যান্ত দেবীকে দেখছি।
- হইছে, হইছে। থাম এবার। আমরাও না! সেই কোন সময় বলসি আল্লাহ হাফেজ, এখনো কথাই বলতেসি। আচ্ছা যাই রে। আবার দেখা হবে ইনশাআল্লাহ।
সৌরভ এবার মাথা নিচু করে একটা মুচকি হাসি দিলো, 
- সাবধানে যাইস! 
সুহা একটু সামনে গিয়ে একটা রিকশা ঠিক করে নিউমার্কেটের দিকে রওয়ানা হলো। সৌরভও একটা রিকশা নিয়ে তার বাসার দিকে চলে গেলো।
বাসায় ফিরে সুহা সরাসরি তার বাবার রুমে গেল। তার বাবা তাকে দেখে বললেন, 
- কেমন আছিস মা? কিছু বলবি?
- আলহামদুলিল্লাহ ভালোই আছি, বাবা। বাবা, আমি একটা কথা বলবো। কথাটা হয়তোবা শুনতে খারাপ লাগবে; কিন্তু কথাটা জরুরি।
বাবা ইউনিভার্সিটির খাতাগুলো দেখছিলেন। সেগুলো টেবিলে রেখে বললেন,
- বল, মা। কী বলবি?
সুহা একটু দম নিলো। কারণ, সে যে কথাটা বলতে চায়, তার জন্য একটু সাহস দরকার। 
- বাবা, আমি আমাদের বিয়ের তারিখটা আরো একবছর পেছাতে চাই। আমার মনে হয় আমি রিফাতকে আরো বুঝতে চাই। আরো চিনতে চাই।
- হুমম, হ্যাঁ, তা করাই যায়। কিন্তু, মা। হঠাৎ এই সিদ্ধান্ত কেন? তোর সাথে তো ওর ৬ বছরের সম্পর্ক, তাই না?
- বাবা, অনেক সময়ে অনেক চেনা মানুষকেও অচেনা মনে হয়। আবার, একেবারে অচেনা মানুষকেও চেনা মনে হয়। তুমি ওদেরকে বলে দাও। আমার আরো ১ বছর সময় লাগবে।
- (স্মিতহেসে) আচ্ছা, মা। তুই যা বলিস তাই হবে। আমি ওদেরকে বলে দিচ্ছি।
সুহা তার বাবাকে জড়িয়ে ধরলো। জড়িয়ে ধরার পর তার চোখ দিয়ে অশ্রু গড়িয়ে পড়তে লাগলো। তার বাবা তার চোখে পানি দেখে বলল,
- ধুর, পাগলী। কান্না করছিস কেন? তোর কথা ঠিকই আছে। বিয়ে তো আর কোনো ছেলেখেলা না। সারাজীবনের জন্যে এক হয়ে থাকার একটা বন্ধন। ভেবেচিন্তেই সব ডিসিশন নিতে হবে। তোর ডিসিশন তো ঠিকই আছে। যা, তুই গিয়ে ফ্রেশ হয়ে নে।
সুহা তার বাবার কথা শুনে ফ্রেশ হতে গেল। ফ্রেশ হয়ে এসে সে সিদ্ধান্ত নিলো রিফাতের সাথে কথা বলবে। সে রিফাতকে ফোন দিলো। 
প্রতিবারের মতোই রিফাত ৩-৪বার ফোন দেয়ার পর রিসিভ করল। 
- (রাগত স্বরে) কী, সুহা। শুনলাম, তুমি আমাকে আরো চিনতে চাও। কেন? এই ৬ বছরে আমাকে চেনা হয়নি?
- (বিনয়ের সাথে) চেনা হলে হয়তোবা শুধু শুধু তারিখ পেছাতাম না। যাই হোক। রিফাত, তোমাকে একটা কথা বলার জন্যেই ফোন দেয়া। এতোদিন তুমি আমার সাথে যেসব দুর্ব্যবহার করেছো, এর অধিকার তোমার ছিল না। হ্যাঁ, আমি তোমাকে ভালোবাসি। কিন্তু তাই বলে, তুমি আমার সম্মানে আঘাত করতে পারো না পাবলিক প্লেসে। আমি অনেক অপমান সহ্য করেছি, আর না। এবার থেকে, জেনে রেখো, আমিও কিন্তু চুপ থাকব না। তখন কিন্তু একটা সিন ক্রিয়েট হয়ে যেতে পারে। 
রিফাত কিছু বলে ওঠার আগেই সুহা বললো,
- আজ রাখি। ভালো লাগছে না আমার।
রিফাত কিছু একটা রাগ করে বলার চেষ্টা করলো ঠিকই; কিন্তু, বলার আগেই কল কেটে গেলো। রিফাত বিড়বিড় করে বললো, “ইডিয়েটটা তো ভালোই কথা বলা শিখেছে। একে আর দরকার নেই আমার। আমি যে চাকরি করি, তার দিয়ে এর চাইতে আরো বহুত গুণে সুন্দরী মেয়ে লাইন ধরবে। নিশ্চয়ই কোনো কোটিপতির গলায় ঝুলে যাওয়ার সুযোগ পেয়েছে। আর, এমনিতেও আমার নাদিয়া ওর চাইতে হাজারগুণে সুন্দর। একে রেখে লাভ কী?”


অন্যদিকে, সুহা আজ নিজেও যথেষ্ট অবাক। যে কোনোদিন তার ভালোবাসার মুখের ওপরে কোনো কথা বলেনি, সে আজ তার অধিকারের দায়ে কথাগুলো বলতে একপ্রকার বাধ্য হলো। অবশ্য সুহা একটা কথা মনে প্রাণে বিশ্বাস করে- মানুষের যখন পিঠ দেয়ালে ঠেকে যায়, তখন আর কিছুই করার থাকেনা। তখন সত্য যত কুৎসিতই হোক না কেন, সেটা মুখ দিয়ে বের করতে হবেই। 
সু্হা আজ তার মোবাইলের ফেসবুকে ঢুকলো। ঢুকেই প্রথমে ‘নরকের কবি’ লিখে সার্চ দিলো। প্রথমেই সৌরভের প্রোফাইল আসলো। সুহা যা ভেবেছিল, সেটাই প্রোফাইল পিকচার। গিটার হাতে নিয়ে প্রাণবন্ত হাসিতে মেতে আছে সৌরভ, ঠিক তখনই তার বন্ধু ছবিটা তুলেছে। প্রোফাইলের ভিতরে ঢুকে কভার ফটোর দিকে তার চোখ গেল। কভার ফটোতে বয়স্ক এক জুটির ছবি। খুব সম্ভবত, সৌরভের বাবা-মা।
যাই হোক, সুহা আইডিতে রিকোয়েস্ট পাঠালো। এর কয়েক মিনিট পরই ফোন থেকে টুইং করে একটা শব্দ হলো। সুহা মোবাইল অন করে দেখল সৌরভ ফ্রেন্ড রিকোয়েস্ট অ্যাক্সেপ্ট করে ম্যাসেজও দিয়ে দিয়েছেঃ
- নরকের কবির নারকীয় প্রোফাইলে স্বাগতম, হে সুন্দরী!
সুহা কথা বলা শুরু করে দিলো। তাদের কনভার্সেশনটা অনেকটা এরকম হয়ঃ
- কেমন আছিস, সৌরভ? রাতের ডিনার শেষ?"
- আছি, আলহামদুলিল্লাহ্‌ ভালো। তোর কী অবস্থা? আমি এখনো খাইনি, খাবো। তুই খেয়েছিস?
- আমিও আলহামদুলিল্লাহ্‌ ভালো। না রে, আমিও এখনো খাইনি। একটা কথা বলার ছিল রে।
- আরে, বলে ফ্যাল্‌।
- আচ্ছা, একটা অনেকদিনের সম্পর্কে যদি একদম প্রথম থেকে দুজনের একজন, অন্যজনকে কথায়, কাজে হেয় করে, সম্মানে আঘাত দেয়, অপমান করে, তাহলে দ্বিতীয়জনের কী করা উচিত?"
- এটা তো তাহলে কোনো সম্পর্কের ক্যাটাগরিতেই পড়েনা। সম্পর্কে কখনোই domination থাকেনা। আর, সম্মান হলো সম্পর্কের সবচাইতে বড় উপাদানের একটা। যে সম্পর্কে পরস্পরের প্রতি সম্মান নেই, সেটা তো সম্পর্কই না। তুই যেটা বলছিস, ঐটা আদতে কোনো সম্পর্ক না, ঐটারে ঔপনিবেশিক শাসন বলা চলে। 
- অ্যাই! তুই এতো সঠিক কথা বলিস কীভাবে? বলতো।
- মানুষ হয়েছি আর সঠিক বলবো না? কেন? তোর প্রেমিকের সাথে তোর কিছু হয়েছে?"
- সত্যি বলতে, হ্যাঁ। হয়েছে। তবে খুব অল্প কিছু। আশা করছি ঠিক হয়ে যাবে। (টেক্সটটা দেয়ার সময় একটু হালকা নিঃশ্বাস ছাড়ল)
- হ্যাঁ, তা-ই ভালো। (টেক্সটটা দেয়ার পর মাথাটা হালকা নিচু করে একটা দীর্ঘশ্বাস ছাড়ল। মনে হলো সে এই কথাটা একেবারে না পারতেই বলেছে। জাস্ট ভদ্রতার খাতিরে)
- হ্যাঁ, আমার একটা কথা মনে হয় কী, জানিস? তুই মানুষের ভিতরটা দেখতে পারিস, তাও আবার চশমা ছাড়া। আর, আমায় যদি চাশমিশও বানায় দেয়া হয়, তাইলেও আমি দেখতে পারবোনা।
- মানুষের ভিতরটা দেখা খুব বেশি একটা কঠিন কাজ না। যাদের হৃদয় এই নাগরিক কোলাহলে একেবারে অতিষ্ঠ, তারা এই দৃষ্টি হারিয়েছে।
- আচ্ছা, আমি তো প্রায় সবই বললাম। এবার বল্‌ তো, আমার প্রেমিক আসলে কেমন?
- তোর প্রেমিক এক পরিণত সুদর্শন রোবট (যদিও আমার চাইতে সুদর্শন না)।
(এবার সুহা অনেকগুলো হাসির ইমোজি পাঠাল। মনে হলো সে খুব মজা পেয়েছে)
- তোর সব কথা বুঝলাম। কিন্তু, তুই ওর থেকে বেশি সুদর্শন? সেটা মানতে পারলাম না। সে দেখতে অনেক সুন্দর।
- হ্যাঁ, সে অনেক সুন্দর হতে পারে। কিন্তু, আমার থেকে সুদর্শন না। তার ভেতরে শক্ত দেয়ালের প্রাচীর। যে প্রাচীরের একপাশ থেকে ‘মনুষ্যত্ব’ বলে জোরে চিৎকার করলেও অপর পাশে যায় না। সে দেয়ালের প্রাচীর, আয়নার মতো এতোই উজ্জ্বল যে সেখানে যেকোনো কিছুই প্রতিফলিত হয়। তার সে আয়নায় কোনো মানুষের ছবি প্রতিফলিত হয় না। সে আয়নায় প্রতিফলিত হয় একদল ক্ষুধার্ত হায়েনার ছবি, যে হায়েনারা নিজ স্বার্থের জন্যে আপন শিশুকেই হত্যা করতে পারে নৃশংসভাবে।
- তা, বুঝলাম। আচ্ছা। তার হৃদয়ে কি আদৌও কোনো মানুষ জায়গা পেতে পারে?
(সৌরভ এবার কিছু হাসির ইমোজি পাঠাল।সুহা এতে বিন্দুমাত্র আনকম্ফোর্ট ফিল করেনি। কারণ, সে জানে সৌরভ অকারণেই হাসেনা। কোনো না কোনো কারণ আছেই)
- কীরে? প্রশ্নের উত্তর না দিয়ে হাসছিস কেন?"
- আচ্ছা, আচ্ছা। উত্তর দিচ্ছি। তার হৃদয়ে মানুষ কী করে থাকবে? জায়গাই তো নেই।
- জায়গা থাকবেনা কেন?
- তার হৃদয়ে যেখানে কোনো মানুষ থাকার কথা, সেখানে আছে সাইনথিটা, কসথিটা, টেনথিটা, সাথে আছে যোগজীকরণ, অন্তরীকরণের সব অংক। মানে ছোটোখাটো একটা হিসেবের মেশিন তোর প্রেমিক। মেশিনের সাথে অন্তত প্রেম-ভালোবাসা সম্ভব না।
- জি, বুঝতে পারলাম, সুদর্শন পুরুষ। এবার খেয়েদেয়ে ঘুমান, জ্ঞানের আধার।
- জি, সুন্দরী। আপনিও ঘুমান। অনেক রাত হলো বলে।
(এবার দুজনেই কতগুলো হাসির ইমোজি পাঠাল। দুজনেই আপনি, আপনি বলায় মজা পেয়েছে)


পরদিন সকাল।
সুহার মন কিছুটা খারাপ। আর যাই হোক, রিফাত তার ভালোবাসা। রিফাতকে একটা সরি অন্তত বলা দরকার। সে হয়তো একটু বেশিই বলে ফেলেছে। সে রিফাতকে কল দিলো। সুহা ‘হ্যালো’ পর্যন্ত বলতে পারল না, সাথে রিফাত বলে ওঠলো,
- হ্যালো। নিজেকে খুব বড় মনে করো, তাই না? তোমাকে আর ভালোবাসার বিন্দুমাত্রও ইচ্ছা নাই আমার। ভালো তো বাসিই নি কোনোদিন। আমি নাদিয়াকে ভালোবেসেছি, ব্যস্‌। তোমার চেয়েও বহুত গুণে সুন্দরী। আর, তুমি আমার যোগ্যও না। বামন হয়া আসছে চাঁদ ছুঁতে। 
কল কেটে গেলো।
সুহার নীরবতাতেই কথা শুরু, সুহার নীরবতাতেই কথা শেষ। তবে সুহার আজ কোনো কান্না পায়নি। কারণ, কালকে রাতে সৌরভের বলা কথাগুলো তার মাথায় গেঁথে গেছে। ‘ভালোবাসি’ বলে তাকে আমার পেতেই হবে, এমন কথা তো কোথাও লেখা নেই। তাছাড়া যে আমায় ভুলতে পারে, আমিও তারে ভুলতে পারি- সুহা অনেকটা এই মতাদর্শে বিশ্বাসী। ফোনটা হঠাৎ টুইং শব্দে বেজে উঠল। সুহা দেখল, সৌরভ ম্যাসেজ দিয়েছে।
- কীরে দেবী? কালকের কথায় খুব কষ্ট পেয়েছিস না?
- না, তো। কষ্ট কেন পাব?"
- তোর প্রিয় মানুষকে নিয়ে অনেক নেগেটিভ কথা বললাম তো, তাই।
- আরে না, ছাগল। কষ্ট পাব কেন? যে মানুষটা আমাকে ভালোইবাসেনি, তাকে নিয়ে কষ্ট পাওয়ার কী আছে?
- হুম, বুঝলাম। আজকে বিকেলে বের হবি? তোর মুডটা ভালো করে দেই।
- তা বের হওয়াই যায়।
সুহার মন কিছুটা ভালো হলো। সে জানে সৌরভ মানুষের মন ভালো করার টেকনিক খুব ভালোভাবে জানে। রিফাতের জন্যে তার অনেক কষ্ট হচ্ছে। একটা মানুষ বদলে গেল, নাকি সে-ই নিজে চিনতে ভুল করল, কে জানে। ছয় বছর ধরে সম্পর্ক থাকার পরেও সে এই ভুল করলো। অবশ্য, ভুল মানুষ-ই করে। অন্যান্য প্রাণীরাও করে, কিন্তু তাদের ভুল করার পরও শিক্ষা হয়না। মানুষ আর অন্য প্রাণীর ভেতর বিস্তর ফারাক এখানেই। তারা দুজনেই বিকেলে দেখা করল। প্রতিবারের মতো সৌরভ একটা গান গাইলো, সুহাকে নিয়ে চা খেলো, ঢাকা মেডিকেলের বহির্বিভাগের বাইরে এক মামা ভাজাপোড়া বিক্রি করে-সেখান থেকে খেলো, সুহাকে বেলুনে শ্যুট করতে দিলো। একটা বেঞ্চে দু’জন বসল, কথাচ্ছলে সৌরভ নিজের জীবনের কিছু হাসির ঘটনা শেয়ার করলো। একটা ঘটনা এমনঃ
সৌরভ তখন ক্লাস টেনে পড়ে। সেবার তাদের শ্রেণি শিক্ষক একটা নাটক করতে বলেছিলেন স্বাধীনতা দিবস উপলক্ষে। নাটকটা ছিল মুক্তিযুদ্ধভিত্তিক। সৌরভ সেখানে পাকিস্তানি মিলিটারির চরিত্রে অভিনয় করেছিল। নাটকের মাঝখানে সৌরভ ও তার রাজাকার সহকারীরা এক তরুণ মুক্তিযোদ্ধাকে বেঁধে নিয়ে আসে। তাকে দড়ি দিয়ে বেঁধে মাটিতে ফেলে রাখে। সেসময়ে সেই তরুণ যোদ্ধা বলে উঠে,
- জয় বাংলা! আমাকে তোরা রুখতে পারবি না। যুদ্ধ আমরা করবোই! 
তখন সৌরভের সহযোগী রাজাকারের একটা ডায়লগ ছিল এরকমঃ
- ওস্তাদ! শালারে একটা গুলি কইরা ভুঁড়ি ফুটা কইরা দেন। তাইলে যুদ্ধের মজা বুঝবো।
আবার নাটকের শেষদিকে গ্রেনেড হামলায় যখন সৌরভ ও তার দলবল নিহত, তখন সৌরভ ও তার বন্ধুরা একটু একটু চোখ মেলে আর আস্তে আস্তে কথা বলে, 
- মামা, নাটক এখনো শেষ হয় নাই? নাকি এখনো স্টেজে মরার মতো পইড়া থাকবো?
এই কথা শুনে সুহার অনেক হাসি পেল। সুহার মন মোটামুটি ঠিকঠাক। পরে সন্ধ্যায় সুহা বাসায় ফিরে আসে। তারপর তাদের কথাবার্তা এমনই চলতে থাকে নিয়ত। দিন যায়, মাস যায়।


হঠাতই মার্চ মাস আসে। মার্চে সুহার জন্মদিন।
যে দিন জন্মদিন, তার ঠিক আগের দিন সৌরভ সুহার কোনো কল ধরছিল না। সুহার একটু টেনশন হচ্ছিল, সৌরভের কিছু হলো না তো?
রাত প্রায় বারোটা। আকাশে তখন শুক্লপক্ষের চাঁদ।
সুহার বাসার সবাই ঘুমিয়ে গেছে। সুহার মন এখনো কেমন জানি করছে সৌরভের জন্য। ছেলেটার কোনো খোঁজ-খবর পাওয়া গেল না। 
হঠাৎ ফোনটা টুইং শব্দে বেজে উঠল। সুহা লাফিয়ে ফোনের ওপর পড়ল। সৌরভের ম্যাসেজ না তো? হ্যাঁ, তার শঙ্কা কেটেছে। সৌরভই এই ম্যাসেজ দিয়েছে।
- অ্যাই, বারান্দায় আয়। জলদি!!
- এই গাধা! সারাদিন কোথায় ছিলি?
- সবকিছু বলছি, ম্যাম। আপনি আসুন তো আগে বারান্দায়!
- বারান্দায়? বারান্দায় কী করব?
- আরে, বাপ। আয় না।
- আচ্ছা, আসতেছি।
বাইরে এসে সুহা দেখে, সৌরভ তার বারান্দার নিচে রাস্তায় দাড়িয়ে আছে। ল্যাম্পপোস্টের আলোয় সৌরভকে দেখা যাচ্ছে, হাতে কালো গিটারটা ঝিকমিক করছে। সৌরভ হঠাৎ সেখান থেকেই উইশ করতে লাগলো।
হ্যাপি বার্থডে টু ইউ। হ্যাপি বার্থডে টু ইউ।
হ্যাপি বার্থডে ডিয়ার সুহা। হ্যাপি বার্থডে টু ইউ। 
সুহার অবস্থা পুরো ‘কিংকর্তব্যবিমূঢ়’ টাইপ।
সুহার হাতের ফোন টুইং শব্দে বেজে উঠল।
- এটা তোর বার্থডের ছোট্ট একটা সারপ্রাইজ ছিল।
- তুই কি একটা পাগল?
- হতে পারি। জানিনা। তোর নামের প্রথম অক্ষর ‘S’ না? ‘শিরোনামহীন’ ব্যান্ডেরও প্রথম অক্ষর ‘S’। ওদের গাওয়া একটা গান গাই।
সৌরভ গাওয়া শুরু করলোঃ
“মেঘ ঝরে ঝরে বৃষ্টি নামে,
বৃষ্টির নাম জল হয়ে যায়।
জল উড়ে উড়ে আকাশের গায়ে,
ভালোবাসা নিয়ে বৃষ্টি সাজায়।
ইচ্ছেগুলো ভবঘুরে হয়ে, চেনা-অচেনা হিসেব মেলায়।
ভালবলোসা তাই ভিজে একাকার;
ভেজা মন থাক রোদের আশায়।
ইচ্ছে হলে ভালোবাসিস, না হয় থাকিস।
যেমন থাকে স্নিগ্ধ গাংচিল...”
তারপর হঠাৎ মনে হলো সুহার বাসার লোকজন জেগে গেছে। তার ঘরের দিকে আসছে এমন পায়ের আওয়াজ পাওয়া গেলো। সুহা সৌরভকে ম্যাসেজ দিলো।
- অ্যাই, সৌরভ। তাড়াতাড়ি যা এখন। বাবা মনে হচ্ছে আসতেসে আমার রুমের দিকে। দেখলে সমস্যা।
- দেখলে তো সমস্যা দেখিনা। দেখলে বিয়েও করায় দিতে পারে তোর সাথে। তোর মতো সুন্দরী বউ পাইলে যে কেউ খুশি।
- হইছে আমার মহাপুরুষ। যান এইবার, নাইলে বাপ এসে আপনার হাড্ডি ভেঙে দিবে। তখন উক্তি ছাড়ার মতো সময় থাকবেনা!
- আচ্ছা যাচ্ছি, বাবা। তবে কাল সকাল সকাল দেখা করিস। দরকার আছে। এক জায়গায় নিয়ে যাবো তোকে।
- আচ্ছা, আসবোনে। আল্লাহ হাফেজ!
সৌরভ প্রত্যুত্তরে ‘আল্লাহ হাফেজ’ বলতে যাবে, ঠিক এমন সময়ে সুহাদের অ্যাপার্টমেন্টের কুকুরটা সজাগ হয়ে গেট থেকে বেরিয়ে এল আর সৌরভকে ধাওয়া করল। সৌরভ কোনোরকম শুধু গিটারটা নিয়ে দৌড়। পিছনে কুকুরটাও সমান বেগে দৌড় দিলো। আজ বোধহয় সৌরভকে না কামড়ে ছাড়বেনা। সৌরভকে এই আধো-আলোতে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের হলগুলোর দিকে যেতে দেখা গেল।


এদিকে সুহার আজ ঘুমই আসছেনা; নানাধরনের চিন্তাভাবনা মনে আসছে। সৌরভ কালকে কোথায় নিয়ে যাবে আল্লাহ জানে। সুহার মাঝে মাঝে ভয় করছে। যদি খারাপ কিছু হয়? কারণ, সৌরভের সাথে তার বন্ডিং বেশিদিনের না। আবার সুহার এটাও মনে হচ্ছে, সৌরভকে তো এমন মনে হয়না। কী জানি, কী হয়। এতোকিছু ভাবতে ভাবতে সে ঘুমিয়ে পড়ল।


সাধারণত মনে ঘোর চিন্তা বাসা বাঁধলে ঘুম হালকা হয় আর ভাঙেও তাড়াতাড়ি-সেরকমই হলো। সকাল ৬টায় তার ঘুম ভাঙল। ঘুম থেকে উঠেই মোবাইলটা চেক করে দেখল সৌরভ ম্যাসেজ দিয়েছে। সকাল ৭টায় নিউমার্কেটের সামনে থাকতে বলেছে। সে ফ্রেশ হয়ে রেডি হয়ে নিলো। তবে যাওয়ার সময় তার হ্যান্ডব্যাগে করে একটা ছুরি নিলো। বলা যায়না, আজকাল পরিস্থিতিও খুব একটা ভালো না। হুমায়ুন আহমেদ স্যারের ‘দেবী’ উপন্যাসে বাড়িওয়ালার মেয়ে নীলুর সাথে সিরিয়াল কিলারের কাহিনিটা মনে গেঁথে আছে সুহার। তাই এতো ভয়।


ঠিক ৭টায় সে এসে দেখে সৌরভ আরো আগেই এসে দাঁড়িয়ে আছে। 
- শুভ সকাল, সুন্দরী। কেমন আছিস?
- আলহামদুলিল্লাহ্‌, ভালো। কোথায় নিয়ে যাবি আমায়?
- অদেখা স্বর্গে।
সৌরভ সুহাকে নিয়ে কমলাপুর রেলওয়ে স্টেশনে পৌঁছালো। এই সকাল সকালও সেখানে পসরা বসেছে। সেখান থেকে একটা হাই পাওয়ার ট্রেনে উঠল, সেকেন্ড ক্লাস একটা বগিতে সিট নিলো। ট্রেনে হরেকরকম মানুষ উঠেছে আর উঠছে। কেউ গ্রামে যাবার গল্প করছে, কেউ দেশের ব্যবসা-বাণিজ্য, রাজনীতি নিয়ে কথা বলছে, কেউ বাচ্চার কান্না থামাচ্ছে, কেউ প্রেমিকার রাগ ভাঙাচ্ছে। আর সৌরভ? সে তার গিটার নিয়ে প্রস্তুত। ট্রেন কিছুসময় পরেই চলা শুরু করল, গিটারেও সুর উঠল। ট্রেনে সে বেশকিছু সাইকেডেলিক রক গান গাইলো। এর মধ্যে সুহার ভালো লেগেছে ‘অন্ধ দেয়াল’, ‘অন্তরায়’, ‘গল্পের শুরু’, ‘এপিটাফ’। ‘এপিটাফ’ গানটা সুহার অনেক ভালো লাগায় সৌরভ গানটা আরেকবার সম্পূর্ণ শেষ করলো এভাবেঃ
“যুদ্ধ শেষে এবার বাড়ি ফিরে,
দেখি যে তুমি নেই পাশে।
ভেবেছিলাম তুমি থাকবে দাঁড়িয়ে,
কৃষ্ণচূড়া ফুল হাতে।
তবে কি যুদ্ধে গেলাম তোমায় হারাতে?
এপিটাফের লেখাগুলো পড়ি ঝাপসা চোখে।
তুমি তো দিয়েছিলে মোরে কৃষ্ণচূড়া ফুল।
আমি তো বসেছিলাম নিয়ে সেই গানের সুর।
তুমি তো দিয়েছিলে মোরে কৃষ্ণচূড়া ফুল।
চলে গেছো কোথায় আমায় ফেলে, বহুদূর...”
সুহা এর আগে কখনো ট্রেনে উঠেনি। তাই খানিকটা এক্সাইটেড। ট্রেন যখন জোরে চলা শুরু করল, তখন সুহা অবাক হয়ে চেয়ে রইল। মনে হচ্ছে তারা বসে আছে, আর বাইরের সবাই দ্রুত মিলিয়ে যাচ্ছে, মনে হলো যেন গাছ, মাঠ, ল্যাম্পপোস্টগুলো দৌড়াচ্ছে। ভালোই লাগছে দেখতে।
একটু সময় যেতেই ট্রেন নরসিংদীতে প্রবেশ করল। ধানক্ষেত যখন ট্রেন পাড়ি দিচ্ছিল, এর সাথে আবার কুয়াশা ঢাকা চারপাশ, মনে হচ্ছিল কোনো রহস্যের গর্ত থেকে ট্রেনটা বের হচ্ছে। সুহার কিছুটা ভয়ও হলো। যদি সৌরভ কিছু একটা করে বসে। যদিও সে ছুরি নিয়ে এসেছে।
ট্রেন এরকম প্রায় ৩ ঘণ্টা চলার পর চট্টগ্রামের সীতাকুণ্ডে থামল। স্টেশন থেকে বের হয়েই তারা একটা হোটেলে নাস্তা করে নিলো। সেখানকার তান্দুরি রুটি, হালিম আর মেজবানি গরুর গোস্ত খেয়ে সুহা অবাক। এত সুস্বাদু খাবার সে কখনো খায়নি। সে সৌরভকে ধন্যবাদ দেয়ার সাথে সাথে সৌরভ বললো,
- এখনো বার্থডে কুইনের জন্য কিছুই করা হয়নি। 
সুভা হতভম্ব হয়ে তাকিয়ে রইল। বলে কী সৌরভ?
নাস্তার পরে তারা একটা উবারে করে চন্দ্রনাথ পাহাড়ের তলায় উপস্থিত হলো। সুহার যেন পুরো চোখ জুড়িয়ে গেল। প্রকৃতির এমন রূপ সে কখনো দেখেনি। 
সকাল তখন ১১টা বেজে গেছে। কিন্তু চন্দ্রনাথ তখনও কুয়াশা ঢাকা। সৌরভ আর সুহা দুজনেই একটা করে লাঠি নিয়ে পাহাড়ে চড়া শুরু করল। আস্তে আস্তে চড়তে চড়তে দেখা গেল পিছনে সামনে বহুত সওয়ার হেঁটে উঠছে। পাহাড়ের চারপাশে মানুষ উঠছে, গাইছে, হাসছে, কাঁপছে, একটু-আধটু পাখির বোল শোনা যায়। এরমধ্যে চন্দ্রনাথ পাহাড়ের মাঝে গিয়ে তারা একটা ব্রেক নিলো। পথের পাশেই একটা লোক পাখির খাবার বিক্রি করছিল। সৌরভ সে লোকটার কাছে এক মুঠো কিনে হাতে একটু পাখির খাবার নেয়ার সাথে সাথে একটা পাখি এসে তার হাতে বসলো। পাখিটা সুহার দিকে তাক করে সৌরভ বললো,
- হতাম যদি সোনালি ডানার চিল, আকাশের ঐ প্রান্ত থেকে একবিন্দু মেঘ এনে দিতাম তোমার ডানায়। 
আর এই সুহা ভাবছিল সৌরভ এই বুঝি তাকে খুন করে? সুহার মন তো চাইছে এই পাখিদের সাথে উড়ে ঐ মেঘের ঐ দেশে হারিয়ে যেতে আনমনে। ঠিক সেসময়ে সৌরভ আরেকটা পাখি ধরে এনে সুহার কাছে দিয়ে বললো,
- হতাম যদি একটা বিরাট বড়ো গাঙচিল, তোকে নিয়ে উড়ে যেতাম ঐ মেঘের মোহনায়।
- (অবাক হয়ে) একটু আগেনা বললি সোনালি ডানার চিল হবি? এখন আবার গাঙচিল কেন?
- (একটু মুচকি হেসে) বলতে পারিস এই ছেলে এখন গাঙচিল হইতে চায় কেন? কারণ এক বিন্দু মেঘ is not enough for you, man!
এবার সুহা হেসে দিলো। সৌরভ এবারও মুগ্ধ হয়ে চেয়ে থাকল। 
সুহা এবার বললো,
- সৌরভ, আমার একটা কথা আছে।
- বলে ফ্যাল।
- আমি আগে থেকেই জানি তুই আমাকে পছন্দ করিস।কিন্তু, আমি কোনো সম্পর্কে যাইতে চাইতেসিনা। আমার নিজেকে নিরাপদ মনে হয় না এখন। যে কেউই ছেড়ে চলে যেতে পারে। আমি সরি রে। 
সৌরভের হৃদয়ে যেন একটা নিউক্লিয়ার বিস্ফোরণ হলো, তার ক্ষত নিয়েই বললো 
- আচ্ছা ব্যাপার না। আমি সবসময়ই তোর সাথে আছি।
- আচ্ছা, সৌরভ। জীবনে নিরাপত্তা চাওয়া কি ভুল কিছু?
- নিরাপত্তাই যদি সবকিছু হতো, তাইলে আজীবন মাতৃগর্ভে থেকে যেতাম। এই ধুলোর পৃথিবীতে আসতাম না।
ঐদিনটা সৌরভ আর সুহা দুইজনেই আনন্দে কাটাল, যদিও বাড়ি ফিরতে হলো ৩-৪ ঘন্টার মধ্যে, কারণ বাসা থেকে দুজনেরই কল এসেছিল।
সেই দিনের পর স্বাভাবিকভাবেই, বন্ধুত্বের আবেদনে সৌরভ সুহার সাথে অনেক, বহু বার কথা বলার চেষ্টা করেছে। কিন্তু, সুহা যোগাযোগে কোনো আগ্রহ দেখায় নি। সৌরভ বহুবার অনুরোধ করেছে টিএসসির মোরে আসতে, একটু গান শুনতে, কিন্তু সুহা অপারগ। দুজনের এরপর কী কারণে আর কখনো দেখাও হয়নি। সৌরভ যে চেষ্টা করেনি, এমন নয়।কিন্তু সুহার সিদ্ধান্ত পরিবর্তন হয়নি। সেই প্রাকৃতিক কারণের সৌরভ ঠাহর করতে পারল না। 




২০৫০ সাল।
জানুয়ারি মাসের প্রথম দিন। 
শীতের সকাল।


মুখে হালকা দাড়ি, চোখে চশমা, মাথায় মাঝারি ধরনের কাঁচাপাকা চুল, হাতে একটি ফাইল নিয়ে ৪৮ বছর বয়সী সৌরভ গবর্নমেন্ট ল্যাবরেটরি হাই স্কুল, ঢাকা-এর ভিতরে ঢুকছে। সে এই প্রতিষ্ঠানের কলেজ শাখার প্রাক্তন ছাত্র। এখন প্রতিষ্ঠানটিতে শিক্ষক ঘাটতি চলছে বিধায় শ্রদ্ধেয় আহসানউল্লাহ স্যার তাকে গেস্ট টিচার হিসেবে যোগদান করতে বলেছেন। আজকেই তার প্রথম ক্লাস।
কলেজে ঢোকার সাথে সাথেই আহসানউল্লাহ স্যারের সাথে দেখা। স্যারের পা ছুঁয়ে সালাম করতে গিয়ে সৌরভ কান্না করে দিলো। এটা খুব সম্ভবত আনন্দের অশ্রু। স্যারও তাকে জড়িয়ে ধরলেন। ল্যাবরেটরিয়ানরা কখনো প্রাক্তন হয়না- এই এর উৎকৃষ্ট প্রমাণ। স্যার বললেন যে তাকে স্কুলের প্রথম শ্রেণির শ্রেণি শিক্ষকের দায়িত্ব তাকে পালন করতে হবে।
ক্লাসের ঘণ্টা বেজে উঠল। সৌরভ হাতে নাম ডাকার খাতা নিয়ে মৃদু পায়ে ক্লাসের দিকে চললো। সেই প্রাণপ্রিয় ক্যাম্পাস। আরে, ২০২০ নম্বর রুমটা এখনো আছে? ভিতরের পরিবেশ... আহা! দেখে সৌরভের চোখ জুড়িয়ে গেলো। কত স্মৃতি জমা আছে এখানে তার। নস্টালজিক হয়ে গেল সে, আনন্দের অশ্রু মুছে সৌরভ ক্লাসে প্রবেশ করল।
- আসসালামু আলাইকুম, স্যার। 
কিউট বাচ্চাগুলোর দাঁড়িয়ে মিষ্টি গলায় সম্মান প্রদর্শন দেখে সৌরভ টাসকি খেয়ে গেল আর মুগ্ধ হলো। আজ বাবা-মা বেঁচে থাকলে দেখলে খুশি হতেন। 
সৌরভ সালামের উত্তর দিয়ে বলা শুরু করলো, 
- আজ আমরা শুধু গল্প করবো। একে অন্যের সাথে পরিচিত হবো, বন্ধুত্ব করবো। সবাই রাজি তো?
- (সমস্বরে) জিইইইইই, স্যাররররর। 
- আগে আমার পরিচয়টা দিই। আমার নাম সৌরভ। এই যে ফার্স্ট বেঞ্চের ডান দিকে বসা। তোমার নাম কী? 
- সাকিব আহমেদ।
- তারপর একে একে বলতে থাকো।
- আমার নাম জিসান হাসান।
- আমার নাম স্নিগ্ধকান্তি মজুমদার।
এভাবে একে একে সে সবার সাথে পরিচিত হলো। পুরো ক্লাসটা জুড়ে যেমন মজা করল, তেমনি পড়াও হলো। আজ বছরের প্রথম ক্লা স।তাই ছোটোদের এক ক্লাস পরেই ছুটি। ছুটির পর সৌরভ সেই ছোট পাখিগুলোর সাথেই বের হয়ে গিয়ে অফিস রুমে গিয়ে বসল। তার সময়কার শিক্ষক-শিক্ষিকাদের মধ্যে আহসানউল্লাহ স্যার, হারুন স্যার, ইরশাদ ম্যাম, পারভীন ম্যাম, তাহেরা ম্যাম, আমিনুল স্যার আছেন। এঁনাদের সবার সাথে সৌরভ ঘনিষ্ঠভাবে পরিচিত। সবাই তাকে চিনতে পেরে উষ্ণ করমর্দন করে বুকে টেনে নিলো। সৌরভের গাল বেয়ে জল পড়তে লাগল।


স্কুল ছুটি হলো বেলা বারোটায়। সৌরভ হেঁটে নিউমার্কেটের দিকে যাচ্ছিল। একটা বই কিনতে হবে অবসরে পড়ার জন্য। হঠাৎ তার পিছন থেকে কে যেন বলে উঠল,
- স্যার, আসসালামু আলাইকুম। 
সৌরভ পেছনে ফিরে তাকিয়ে দেখল তার আজকের নতুন পরিচিত ছাত্র, সাকিব, ফার্স্ট বেঞ্চের ডান দিকে বসেছিল যদ্দুর মনে পড়ে, এর সাথেই তো প্রথম পরিচয়। সাথে পিছনে দাঁড়িয়ে তার আম্মু। 
- ওয়ালাইকুম আসসালাম, সাকিব। কেমন আছ? 
এটা বলার সাথে সাথেই সৌরভ সাকিবের আম্মুর দিকে তাকিয়ে স্তব্ধ হয়ে গেল। সাকিবের মায়ের দুটো চোখকে তার খুবই চেনা লাগছিল। এই দুটো ডাগর ডাগর চোখের মণির দিকে তাকিয়ে থাকতে পারত সে যুগের পর যুগ। সেই আগের গরিমা, সেই আগের মহিমা, সেই আগের মায়া এখনো মুখে লেগে রয়েছে। সে আর কেউ নয়, সুহা নিজে।


হ্যাঁ, এটা সেই সুহা, যার জন্যে সৌরভ নিজেকে বিক্রি করে দিতেও রাজি ছিল। সোনালি ডানার চিল হয়ে আনতে চেয়েছিল তার জন্য এক বিন্দু মেঘ, গাঙচিল হয়ে তাকে প্রস্তাব দিয়েছিল নিয়ে যেতে ঐ মোহনায়। সৌরভের চোখের পানি মানল না আর বাধা। তার গাল অশ্রুসিক্ত হলো। এক খন্ড বিরাট বড় পাথর ফুঁড়ে জল বের হলে যেরকম লাগে, ঠিক সেরকম। কোনোরকমে সে নিজেকে সামলে নিলো। কিন্তু সুহা ঠিকই তার চোখের জল দেখতে পেল, বুঝতে পারল সবই।  
- সৌরভ, তুই?
- হ্যাঁ, আমি। কেমন আছিস?
- এইতো, আলহামদুলিল্লাহ্‌ ভালো। তুই?
- আছি আলহামদুলিল্লাহ্‌ ভালোই। একটা ক্যাফেতে বসে কথা বলতে পারি?
- (সাকিবের দিকে তাকিয়ে) বাবা, তোকে আজ বাসায় দিয়ে আসি? আমরা অন্যদিন বের হব। আম্মু একটু তোমার স্যারের সাথে কথা বলবে। 
সাকিব হাসিমুখে বললো, 
- আচ্ছা, আম্মু। 
তারপর সুহা সৌরভকে ডমিনোজের সামনে অপেক্ষা করতে বলে সাকিবকে বাসায় দিয়ে আসলো। কিছুক্ষণের মধ্যেই সুহা ডমিনোজের সামনে চলে আসলো। তারপর ডমিনোজে ঢুকে একটা টেবিলে বসার পর সৌরভকে সুহা জিজ্ঞেস করলো,
- কীরে, মুখ অমন ভার করে আছিস কেন? বউ বাসায় বকেছে বুঝি?
(সৌরভ একগাল হাসছে)
- বউ আসবে কোত্থেকে? বিয়েই তো করিনি।
(সুহা খানিকটা অবাক হলো)
- বিয়ে করিসনি এখনো? বয়স তো ৫০ হবে বলে!
- যাকে ভালোবাসি, তাকেই পাইনি। তাই আর বিয়ে-শাদিও করিনি। তা তোর সংসার জীবনের কী খবর?
(এবার সুহা হাসিতে ফেটে পড়ল)
- আমায় যে এতো ভালোবাসে, তাকেই বিয়ে করিনি। আর অন্য কাউকে কীভাবে করি?
- তাহলে সাকিব?
- ওকে আসলে আমি আইনগত দত্তক নিয়েছি। বাসা একদম খালি খালি লাগে এইজন্য। তো সৌরভ সাহেব, আজীবন চিরকুমার থাকবেন?
- যাকে ভালোবাসি, তাকে পেলে তো আর চিরকুমার থাকা লাগেনা।
- আর, যদি আপনার ভালোবাসার মানুষ আপনাকে বিয়ে করে?
- তাহলে করবো মানে? আজকে, এখনই করবো।


এইকথা শোনার সাথে সাথে সুহা সৌরভকে জড়িয়ে ধরল। সাধারণ জড়িয়ে ধরা না। সুহার চোখ দিয়ে তখন বন্যার স্রোতের মতো জল বেরোচ্ছে। সৌরভেরও ব্যতিক্রম নয়। কপোলকে আজ অশ্রুগঙ্গায় ভেসে যেতে হবে, মনের শতবৎসরের আবদ্ধ দুয়ারকে আজ খুলে দিতে হবে অপরের তরে। দুজন দুজনাকে এমনভাবে জড়িয়ে ধরেছে, যেন পার্থিব কোনো শক্তি তাদের আলাদা করতে না পারে। রেস্টুরেন্টে থাকা সবাই এই দৃশ্য দেখে আনন্দে হাততালি দিতে লাগল। দু-এক দর্শকের অশ্রু আটকাল না। 


 
- ওরে ব্যাটা, তাড়াতাড়ি বাড়ি চল্‌। নাহলে আম্মু কিন্তু দিবে নে একদম।
- একটু, বাবা। এই যে, এই যে দেখো। এই আর এক ওভার। 
- (ভ্রু কুঁচকে) তুই কি আবারও আমাকে বকা খাওয়াবি? মনে নেই, আজকে তোর আম্মুর সাথে একটু বাইরে যাবো?
- (বিরক্ত হয়ে) এই যে, দাঁড়াও। একটা ওভারই তো, উফফ্‌। 
ক্লাস শেষ হয়েছে বহুত আগেই। দিবা শিফটের ক্লাস সাধারণত ছুটি হয় ৫টার দিকে, আজ বৃহস্পতিবার বলে ৩টায়। এখন বাজে সোয়া ৪টার মতো কিন্তু, সাকিবের খেলা আর শেষ হয় না। সৌরভ সেই যে এক ঠায় দাঁড়িয়েই আছে তো আছেই। সাকিবের বন্ধুরা সৌরভ স্যার আর তাদের সদা চঞ্চল বন্ধু সাকিবের মধ্যের বন্ধুত্বপূর্ণ ঝগড়াটা প্রত্যেকদিনই উপভোগ করে। বাবা-ছেলে এতো ভালো হতে পারে? তবে আজ হিসাবটা একটু ব্যতিক্রম। 
লাস্ট বলটা করার পর সাকিব এক দৌড়ে ব্যাগগুলো দিয়ে সাজানো উইকেট থেকে নিজের ব্যাগটা নিয়ে বাবাকে সাথে করে দৌড় দিলো বন্ধুদের বিদায় দিয়ে। বাবা-ছেলে সমান তালে দৌড়োচ্ছে- পথিমধ্যে হাসান স্যারের সাথে দেখা।
- স্যার, আসসালামু আলাইকুম। 
- (হাসতে হাসতে) ওয়ালাইকুম আসসালাম। তো, বাপ-ছেলে দৌড় দিয়ে কি এবার গিনেস রেকর্ড ভাঙার তালে আছেন নাকি?
- আর বলবেন না, স্যার। ক্লাস টেনে পড়ে, এখনো বড় হলো না। 
মেইন গেটটা পার হয়ে একটা রিকশা দেখা গেল। সাথে সাথে ওটায় চড়ে বাসার দিকে রওনা দিলেন। আজ অফিসগুলো আগে আগে ছুটি হওয়াতে বাসায় পৌঁছে গেলেন ১০ মিনিটে। বাসায় ঢুকে হাতমুখ ধুয়ে জামা প্যান্ট না ছেড়েই বের হতে যাচ্ছিল সৌরভ, তাড়া আছে তাই। সাকিবকে বাসায় কী করতে হবে, কী খেতে হবে- তার যথাযথ ইনস্ট্রাকশন দিয়ে দরজা খুলে বের হতে যাবেন, তখন-- 
- বাবা।
- কী রে? 
- (গিটারের ব্যাগটা হাতে দিয়ে মুচকি হেসে) আসল জিনিসটাই তো নিতে ভুলে গেলে।  
- এই রে, ভুলেই গেছিলাম। (গিটারের ব্যাগটা কাঁধে ঝুলাতে ঝুলাতে) এইটা না নিয়ে গেলে আজ কপালে দুঃখ ছিল। 
- তাড়াতাড়ি বাসায় এসো, বাবা। বেস্ট অফ লাক। 
সৌরভ অবাক হয়ে এই ছেলেটার দিকে তাকিয়ে রইল। কান্না যেন আসতে চাচ্ছিল আনন্দে চোখে। সাকিবের কপালে একটা চুমু দিয়ে বেরিয়ে গেল সৌরভ।

শরতের বিকেল। 
ঘড়িতে ৫টা বেজে ৪০।


চারিদিকে একটা আবছা শীতল বাতাস, আকাশে সাদা মেঘের ভেলা, শাড়ি-পাঞ্জাবি পরে আসা একঢল রমণী ও সুদর্শন যুবকদের ভীড়। সবমিলিয়ে টিএসসি চত্বরের প্রকৃতি এখন এক মায়াবী রূপ ধারণ করেছে। এদের মধ্যেই সাদা-লাল কম্বিনেশনের একটা চমৎকার শাড়ি পরে আসা একটা মহিলাকে একটা গাছের তলায় একাকী বসে থাকতে দেখা গেল। মহিলাটার নামটা অদ্ভুত; সুহাসিনী সরকার মিথেন। তাঁর মা এই ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের চারুকলা বিভাগের সহকারী অধ্যাপক ছিলেন, অনেক বড় একজন রবীন্দ্রভক্ত। কবিগুরুর একটি বিখ্যাত ছোটগল্প থেকে তাই খুব শখ করে মেয়ের নাম রেখেছিলেন সুহাসিনী। আর তাঁর বাবা জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়ের রসায়ন বিভাগের অধ্যাপক ছিলেন। সুহাসিনী তাঁর প্রথম ও একমাত্র মেয়ে হওয়ার কারণে তার নাম রেখে দেন মিথেন। মা তাকে আদর করে ডাকতেন সুহা, আর বাবা আদর করে ডাকতেন মিথি। 


কিন্তু, আজ বাবা-মা নেই। মিথি বলে খুব কম ডাকা হতো তাঁকে, সুহা নামেই অধিক পরিচিত হলেও এ নামে সরাসরি একজনই ডাকার মতো মানুষ আছে তাঁর। তাঁর জন্যই তো বসে আছেন প্রায় আধ ঘণ্টা ধরে। কিন্তু মানুষটা কোথায়? 


নামটা স্মরণ করতেই দেখা গেল দূর থেকে হাসতে হাসতে মধ্যবয়স্ক তরুণ(!) তাঁর দিকে এগিয়ে আসছে। তরুণটার সাজ একদম ঐ দিনটার মতো; লাল রঙের পাঞ্জাবি’অলা, চেহারার রঙ শ্যামল বর্ণের, চুলগুলো কাঁধ পর্যন্ত লম্বা, চোখগুলো মাঝারি ধরনের, হালকা দাড়ি, হালকা গোঁফ, মুখে হাসি ওঠানামা করছে, কাঁধে অ্যাকোস্টিক গিটার হামাগুড়ি খাচ্ছে। এই সাজের ঠাহর করতে করতেই তরুণটা তাঁর পাশে বসল।
- কেমন আছিস, সুহা?
- (অভিমান করে) বাসায় থাকেন তো ২৪ ঘণ্টা, দেখেন না কেমন আছি।
- (সুহার অভিমানের সুরটা বুঝতে পেরে) রাস্তায় জ্যাম ছিল। এখন কি রিকশা ভেঙ্গে-গুড়িয়ে আসব?
- তা পারলেই পারতেন। 
- (একটু হাসি নিয়ে হাতে হাত রেখে) লক্ষ্মীটি আমার। রাগ করো না। 
- (মুচকি হেসে) ইসস, ন্যাকামো। এখনো যৌবন গেল না?
- তুমি বেঁচে থাকতে আমার যৌবন ফুরোবে না।
সুহা হাসতে লাগল। সে হাসির দিকে ঐ দিনের মতো আজও তাকিয়ে রইল সৌরভ। দুটি ডাগর ডাগর মায়াবী চোখ, মাথায় একগোছা চুল, কানে দুল। তার চোখ থেকে এতটাই মায়া নিঃসৃত হচ্ছে যে পরিবেশের অন্যান্য উপাদান কারো চোখে পড়ার সম্ভাবনাই নেই। হাজারো চেষ্টা করেও ছেলেটি তার চোখ সুহার চোখ থেকে সরাতে পারছেনা। তবে আজ সারাটা দিন তাকিয়ে গেলেও যেমন ফুরোবে না তাকিয়ে থাকা, তেমনি লাগবে না লজ্জা। সেদিনের অপরিচিতার চোখ একটুও পাল্টায় নি, তবে তার সাথে সম্পর্ক পাল্টেছে। আজ সে প্রেমিকা, তার স্ত্রী। তাকিয়ে থাকতে লজ্জা কী? 
- কী দেখছিস হা করে আমার চোখের দিকে তাকিয়ে?
- কখনো এতো সুন্দর দেবী দেখার সুযোগ হয়নি তো, তাই।
- সৌন্দর্য দেখছিস শুধু, সৌরভ। প্রেমটা দেখবি না? প্রতিশ্রুতি?
- তোকে তো আমি ভালোবাসি প্রতিনিয়ত। তোমারেই আমি চাহিয়াছি প্রিয়, শতরূপে শতবার।
- তোমারেই করিয়াছি জীবনের ধ্রুবতারা, এই সমুদ্রে আর কভু হবো নাকো পথহারা।
দুই বিখ্যাত কবির গানের দুই লাইন একসাথে বলে তারা হেসে ফেলল কথার মিলন দেখে।


কিছুক্ষণ নীরবতার বিচরণ ছিল। সৌরভ বললো হঠাৎ তার হাত ধরে, মাটিতে এক হাঁটু গেড়ে পড়ে,
- আমি ভালোবাসি তোকে। তোকে প্রচণ্ড ভালোবাসি রে আমি (সুহার হাতের ওপরে নিজের মাথা রেখে, কাঁদতে কাঁদতে)
- (অশ্রু আক্রান্ত হয়ে) তোকে আমি কি কম ভালোবাসি? আমিও তোকে ভালোবাসি রে (সৌরভের মাথার ওপর রেখে)
দুজনে এরকম অবস্থায় কাঁদলো কিছু মুহূর্ত। লোকে দেখলে দেখুক, এই ভাস্কর্য তো প্রেমের ভাস্বর। চিরদিনের ভালোবাসায় সুখ-দুঃখের দ্বন্দ্ব না থাকলে তা ভালোবাসাই না। 
চোখের জল শুকিয়ে গেলে দুজন অশ্রুমাখা গাল নিয়ে একজন আরেকজনের দিকে তাকাল। হেসে ফেলল, প্রাণভরা হাসি। সৌরভের হঠাৎ চোখ পড়ল কাত করে রাখা গিটারটার দিকে। সুহার মন তো এখন ভালো করাই লাগে।
- সুহা, একটা টোটকা খাবি?
- কী?
- একটা গান শুনবি? 
- এই অনুরোধ আমি ফেলে দেব, তা তুই ভাবলি কী করে?
- আজ আমি একটা ব্যতিক্রম কাজ করব। 
- কী রে? কী এমন মহাভারত উদ্ধার করবি? (হাসতে হাসতে)
- আজ তোর পছন্দমতো একটা গান বল।
- তুই এতো ভালো আর হাজার গান শুনিয়েছিস, বলা মুশকিল কোন গান শুনাবো।
- আচ্ছা, চিন্তা কর।
- উমমম, আচ্ছা, গানটার নাম মনে পড়ছে না, কথাটা আবছা মনে পড়ে তবে সুরটা মনে আছে। শুনাই?
- বল তো।
গুনগুন করে সুরটার একটু শুনানোর পরই সৌরভ বুঝে গেল কোন গান।
- আচ্ছা, এই গানটা। এই গান তোর অনেক ফেবারিট, না রে?
- আশ্চর্য!! জানলি ক্যামনে? আমি প্রায়ই গুনগুন করি। 
- (একটা বিজ্ঞ মনোভাব নিয়ে) আমি মনোবিজ্ঞানের ছাত্র, ম্যাডাম। You have to বুঝতে হবে।
দুজনেই হাসতে লাগল।
- (স্মিত হেসে) তবে, সুহা, এইটাই হোক তবে আমাদের এই গল্পের শেষ গান?
- হ্যাঁ, হোক। মুখে হাসি নিয়ে গা, সুমন ভাই খুশি হবে।
অ্যাকোস্টিক গিটারের স্ট্রিংগুলো পেল প্রাণ, এই গানে স্ট্রামিংটা নান্দনিক। চোখ বন্ধ করে গল্পের শেষ গানটা হাসিমুখে গাওয়া শুরু করলো সৌরভ, তার সাথে সুহাসিনীঃ


“যদি ফিরে আসতে চাই, আবার ঘুরে দাঁড়াই
ভেবো না বদলে দিতে চাই পুরোনো মন্ত্রে।
শেষ কথাগুলো শেষ, শেষ ব্যর্থ অবশেষ।
চমকে দেবো আজ তোমার ঘুম ভাঙ্গিয়ে;
আনন্দ-দুঃখে নয়, কাঁদবে বিস্ময়ে!
সূর্যটা জ্বেলে নেব নিজেরই মতো,
ব্যর্থতায় হাবুডুবু নয় কখনো। 
গোধূলীর গায়ে ভেসে যাব আমরা এ দু'জন,
নতুন এক পৃথিবীতে তোমারই মতন...” 

[সমাপ্ত]