পোস্টস

নন ফিকশন

লিগ্যাসি অব উইজডম

২০ এপ্রিল ২০২৪

নূর আন্জুম ইসলাম

মূল লেখক অনির্বাণ রূপ

কোনো একজনের কথা হঠাৎ মনে পড়ায় শে করমাকের একটা ডায়লগের একটা অংশের কথা মনে পড়লো গতকাল; "I was a young man then. I am an older man now, and perhaps wiser." সাথে গেইমের ঐ সীনটাও মাথায় ভাসছিলো; ভার্সাই প্রাসাদে চার্লস ডোরিয়ানকে অ্যাসাসিনেট করে শান্তভাবে প্রাসাদ থেকে বের হচ্ছিলো শে, আর ব্যাকগ্রাউন্ডে এই সংলাপ চলছিলো। তার ফেইসের দিকে তাকালে বোঝা যায় আসলেই সে বুড়িয়ে যাচ্ছে, মুখে বার্ধক্যের ছাপ পড়া শুরু হয়েছে। তখন আরেকটা জিনিস আমার মাথায় আসলো। এই যে সে বললো "I am an older man now, and perhaps wiser." এই Wisdom এর স্বার্থকতা কী? 
উইজডম আর বয়স হলো সমানুপাতিক। তার বয়স যখন একুশ ছিলো, তখন সে ওয়াইজ ছিলোনা। আজ যখন তার বয়স পঁয়তাল্লিশ, সে একটু হলেও ওয়াইজ। কিছুদিন পর যখন তার বয়স হবে সত্তর, তখন সে হবে আরো ওয়াইজ! কিন্তু সমস্যা হলো, বয়স্ক হ‌ওয়ার পর ওয়াইজ হয়ে লাভ কী? ঐ উইজডম কী কাজে লাগবে? সে তো তার এই উইজডম বেশীদিন ব্যবহার করতে পারবেনা, কারণ সে বেশীদিন বাঁচবেই না! তাহলে এই উইজডমের স্বার্থকতা ক‌ই? 

ইনফরমেশন, নলেজ, আর উইজডমের মাঝে পার্থক্য আছে। 
ইনফরমেশন বা তথ্য হলো কোনো কিছুর সম্পর্কে ক্যারেস্টারিস্টিকস বা বৈশিষ্ট্য। পাখি আকাশে উড়ে, পাখির ডানা আছে, পাখির ওজন কম— এগুলো হলো পাখি সম্পর্কে ইনফরমেশন যা কোনো মাধ্যমে (পাখি দেখার মাধ্যমে) পাওয়া যায়।
 
ইনফরমেশনের পরের ধাপ হলো নলেজ। 
জন লক তার আইডিয়া থিওরীতে দুই ধরনের আইডিয়ার কথা বলেছেন; সেনসেশন এবং রিফ্লেকশন। সেনসেশন হলো ইন্দ্রিয়ের দ্বারা আইডিয়া প্রাপ্ত হ‌ওয়া‌। And reflection is the process of thinking about and examining our thoughts, experience and and action. অর্থাৎ রিফ্লেকশন হলো একটা মেন্টাল প্রসেস; অনেকটা নিজের সাথে নিজে কথা বলে কোনো কিছু সম্পর্কে আইডিয়া প্রাপ্ত হ‌ওয়া। 
ইনফরমেশনকে মস্তিষ্ক দ্বারা রিফ্লেক্ট করলে, অর্থাৎ রিফ্লেকশন প্রক্রিয়ার ভিতর দিয়ে গেলে যে রেজাল্ট আসে, তা হলো নলেজ। উদাহরণ হিসেবে, পাখি দেখে পাখির ন্যায় আকাশে উড়তে পারার মতো যানের চিন্তা, এবং পরে তা আবিষ্কার করা হলো নলেজ।

তারপর আসে উইজডম। 'Wisdom' is Noun, 'Wise' is adjective. ওয়াইজ বলতে সাধারণত আমরা জ্ঞানী বুঝি। অর্থাৎ উইজডমের বাংলা হচ্ছে জ্ঞান। কিন্তু জিনিসটা আমার কাছে ঠিক মনে হয়না। কারণ নলেজ অর্থ‌ জ্ঞান, নলেজেবল মানে জ্ঞানী। কিন্তু নলেজ আর উইজডম তো এক না! তো উইজডমের অর্থ ধরি প্রজ্ঞা, এবং ওয়াইজের অর্থ হলো প্রজ্ঞাবান। 
যাইহোক, সোজা ভাষায় উইজডম হলো আহরিত নলেজকে ইউটিলাইজ করার সক্ষমতা; কোথায় নলেজ ইউজ করা যাবে আর কোথায় করা যাবেনা সেই বোধকে বলা হয় উইজডম। অর্থাৎ উইজডম হলো এক প্রকার জাজিং (Judging) অ্যাবিলিটি। 
অ্যাসাসিনস ক্রিড ২ গেইমে এৎযিওর বন্ধু লিওনার্দো দা ভিঞ্চি যখন পাখির আদলে একটা উড়োজাহাজ বানায়, সে সেটা এৎযিওকে ব্যবহার করতে দেয় এৎযিওর উদ্দেশ্য পূরণে। কারণ ভিঞ্চি জানতো এৎযিওর উদ্দেশ্য মহৎ, তার হাতে কোনো কিছু পড়া মানে সঠিক মানুষের হাতেই পড়া। এই যে দা ভিঞ্চি তার সেই উড়োজাহাজকে ইউটিলাইজ করলো, এই জাজিং অ্যাবিলিটিই হলো উইজডম। 
মানুষের মস্তিষ্ক ইনরমাস অ্যামাউন্টে ইনফরমেশন কনজিউম করে। তারপর সেই ইনরমাস অ্যামাউন্টের ইনফরমেশনকে রিফ্লেক্ট করে জ্ঞান বা নলেজপ্রাপ্ত হয়। আর জ্ঞানপ্রাপ্ত হতে হতে তার বয়স যত বাড়ে, অভিজ্ঞতা যত বাড়ে, উইজডম‌ও তত বৃদ্ধি পেতে থাকে। অর্থাৎ উইজডম আর বয়স বা অভিজ্ঞতা হলো সমানুপাতিক। 
এখানে আবার সেই প্রথম প্রশ্ন আসে; যতদিনে ব্যক্তি উইজডমের চূড়ান্ত পর্যায়ে পৌঁছবে, ততদিনে সে তো বৃদ্ধ। সেই উইজডম দিয়ে লাভটা কী হচ্ছে? উইজডমের স্বার্থকতা কী? 
উইজডমের স্বার্থকতা লিগ্যাসি তৈরীর মাঝে! 

আমি যত গেইম খেলেছি এখন পর্যন্ত, আমার দেখা সবচেয়ে ওয়াইজ দুই চরিত্র হলো আলতাইয়ার ইবন লা'আহাদ এবং এৎযিও অডিটোরে দ্য ফিরেন্জে। দুইজন‌ই অ্যাসাসিন; অ্যাসাসিনস ক্রিড সিরিজের প্রতিচ্ছবি। 
এঁদের কাহিনীর শেষাংশ সংক্ষেপে বলি একটু। 
আলতাইয়ার যখন খবর পেল চেঙ্গিস খানের বাহিনী মাস‌ইয়াফ তথা অ্যাসাসিনদের আস্তানায় আক্রমণ করতে আসছে, তিনি ক্যাসেলের একদম নিচে এক গোপন লাইব্রেরী তৈরি করালেন। কিন্তু সেই লাইব্রেরীতে কোনো ব‌ই রাখলেন না। তাঁর কাছে যত ব‌ই ছিলো, তার সব‌ই পর্যটক এবং বন্ধু মার্কো পোলোর সাথে পাঠিয়ে দিলেন। সাথে তাঁর সেই গোপন লাইব্রেরীর চাবিও মার্কো পোলোকে দিয়ে বললেন পৃথিবীর কোথাও লুকিয়ে রাখতে, যোগ্য লোকের খুঁজে বের করার অপেক্ষায়। 
এরপর ৯৩ বছর বয়সী আলতাইয়ার প্রাসাদের সব বাতি বন্ধ করে ধীরে ধীরে গিয়ে সেই লাইব্রেরীতে বসলেন, এবং ছেলে দারিমকে নির্দেশ দিলেন লাইব্রেরীর দরজা বাইরে থেকে বন্ধ করে চলে যেতে। এরপর আলতাইয়ার তাঁর হাতে একটা আর্টিফ্যাক্ট, যাতে স্টোর করা আছে আলতাইয়ারের যাবতীয় জ্ঞান, ইনসাইট, অভিজ্ঞতা, এবং সর্বোপরি উইজডম! এরপর আলতাইয়ার ঐ লাইব্রেরীতেই মারা যান এবং আড়াইশ বছর ওভাবেই থাকেন! 
আড়াইশ বছর পর, ১৫১২ খ্রিষ্টাব্দে আলতাইয়ারের সেই 'যোগ্য মানুষ' এৎযিও অডিটোরে মার্কো পোলোর ডায়েরী রিসার্চ করে আলতাইয়ারের হিডেন লাইব্রেরীর চাবি খুঁজে বের করে মাস‌ইয়াফ যান এবং লাইব্রেরীতে প্রবেশ করেন। এৎযিওর ধারণা ছিলো লাইব্রেরীতে প্রচুর ব‌ই থাকবে! কিন্তু গিয়ে দেখে পুরা লাইব্রেরীতে দুটা জিনিস; আলতাইয়ারের কঙ্কাল, এবং আলতাইয়ারের কঙ্কালের হাতে একটা আর্টিফ্যাক্ট। এৎযিও তখন সেই আর্টিফ্যাক্টে টাচ করে এবং আলতাইয়ারের মেমোরী, জ্ঞান, প্রজ্ঞা লাভ করে আরো ওয়াইজ হয়, তাঁর এক্সিস্টেনশিয়াল ক্রাইসিস মোকাবেলা করে। 

আলতাইয়ারের মেমোরী রিলিফ করার পর এৎযিও তাঁর উইজডম দুজন মানুষকে দেন। একজন হলো ডেজমন্ড মাইলস, আরেকজন শাও জুন। এৎযিও জানতো কোনো একদিন আরেক যোগ্য মানুষ আসবে এৎযিওর মেমোরী রিলিফ করার জন্য, এৎযিওর উইজডমকে কাজে লাগানোর জন্য। এৎযিও সেই মানুষের জন্য‌ই তাঁর উইজডম রেখে যান। এর সাথে আরেকটা কাজ করেন এৎযিও, চাইনিজ অ্যাসাসিন শাও জুনকে ট্রেইন করেন। 
অর্থাৎ আলতাইয়ার এবং এৎযিও উভয়‌ই তাদের উইজডমকে পরবর্তী প্রজন্মের জন্য স্টোর করে রেখে গেছেন যাতে পরবর্তী প্রজন্ম সেগুলো ইউটিলাইজ করতে পারে! এভাবে তৈরী হয় এক লিগ্যাসি। উইজডমের স্বার্থকতা এখানেই, এই লিগ্যাসি তৈরীতেই! 

পঞ্চাশোর্ধ্ব এৎযিও ভুগছিলেন এক্সিস্টেনশিয়াল ক্রাইসিসে; কেন তিনি অ্যাসাসিন, এতে লাভ কী, তাঁর কাজ কী, তাঁর রোল কী এসব প্রশ্ন তাঁর মাথায় ঘুরতো। আর এসব প্রশ্নের উত্তর আলতাইয়ার তাঁর ৯৩ বছরের জীবনেই পেয়ে গেছেন, এবং বুঝেছেন পরবর্তীতেও আবার কেউ এই এক্সিস্টেনশিয়াল ক্রাইসিসে ভুগবে। এই কারণেই আলতাইয়ার তাঁর মেমোরী এবং উইজডম রেখে গেছেন, এবং এৎযিও তা খুঁজে বের করে এক্সিস্টেনশিয়াল ক্রাইসিস ওভারকাম করে। আবার এৎযিও জানতো তাঁর ৬৫ বছরের উইজডম কারো না কারো লাগবেই। এবং লেগেছেও! পৃথিবীকে ধ্বংসের হাত থেকে বাঁচাতে ডেসমন্ড মাইলসের লেগেছে এৎযিওর মেমোরী। 
অর্থাৎ পরবর্তী প্রজন্ম যাতে সেইম প্রবলেইমে না পড়ে, সে কারণেই উইজডম রেখে যেতে হবে, এবং এতেই উইজডমের স্বার্থকতা। 
অর্থাৎ উইজডমের স্বার্থকতা লিগ্যাসি তৈরীর মাঝে, জাস্ট প্রাপ্ত হ‌ওয়ার মাঝে না!