পোস্টস

বিশ্ব সাহিত্য

এবার সাহিত্যে নোবেল পাবেন কে?

৪ অক্টোবর ২০২৩

কৃপাসিন্ধু পাল জয়

মূল লেখক কৃপাসিন্ধু পাল জয়

গত কয়েক বছর ধরে যখনই নোবেল পুরস্কারের বিজয়ীদের নাম ঘোষণার সময় আসে তখন সাহিত্যে একটা নাম বেশি করেই শোনা যায়। নামটা হচ্ছে হারুকি মুরাকামি। বিশ্বের সমসাময়িক সাহিত্য নিয়ে যদি আপনার কিছু পরিমাণ ধারণা থেকে থাকে তবে এই নামটা আপনি অবশ্যই শুনে থাকবেন। জাপানি এই লেখক বিশ্বজুড়ে ব্যাপক জনপ্রিয়। আমাদের বাংলাদেশের বইপড়ুয়াদের কাছেও এই নাম অপরিচিত নয়। কাফকা অন দ্য শোর,নরওয়েজিয়ান উড,ম্যান উইথআউট ওমেন এইসব গল্প-উপন্যাস বইপ্রেমীরা হরহামেশাই পড়ে থাকেন।
যদিও মুরাকামির নাম প্রতিবছরই লিস্টে থাকে তবে পাঠকদের আশার উপর জল ঠেলে দিয়ে অন্য কেউ পেয়ে যান। ১৯৭৯ সাল থেকে লেখালেখির জগতে আসার পর থেকে এই জাপানি কথাসাহিত্যিক বিশ্বজুড়ে নিজের আলাদা একটা জায়গা করে নিয়েছেন। জিতেছেন অনেক পুরস্কারও। প্রথম বই ''হেয়ার দ্য উইন্ড সং' এর জন্য পেয়েছিলেন জাপানের গুঞ্জো পুরস্কার। জাদুবাস্তবতা বিষয়ক বিখ্যাত উপন্যাস 'কাফকা অন দ্য শোর' এর জন্য পেয়েছিলেন 'ওয়ার্ল্ড ফ্যান্টাসি অ্যাওয়ার্ড'। তবে এই অসামান্য লেখকের হাতে এখনো ধরা দেয়নি নোবেল সাহিত্য পুরস্কার। গত কিছু বছর ধরে নোবেল বিজয়ীদের নাম ঘোষণার সময় এলেই মুরাকামির নাম বড় আকারে শোনা যায়। এবারও তেমনি। বিভিন্ন বিশেষজ্ঞদের মতে এবার হারুকি মুরাকামির নোবেল পাওয়ার সম্ভাবনা ১/৮। শতকরার হিসাবে বললে যা ১১ শতাংশের চাইতে কিছু পরিমাণ বেশি।
নোবেল পুরস্কার ঘোষণার সময় এলে হারুকি মুরাকামিকে নিয়ে যে রকম মাতামাতি হয় সেটা আর কাউকে নিয়েই হয় না বলা চলে। তবে এই তালিকায় আরও অনেকের নাম আছে যারা এবার সাহিত্যের সবচাইতে মর্যাদাপূর্ণ পুরস্কারটি নিজের করে নিতে পারেন। বিশেষ করে বলা চলে চীনের নারী সাহিত্যিক ক্যান জোয়ে'র নাম। চীনের সাহিত্যঅঙ্গনে এই নামটি অনেকদিন ধরেই একটা বড় জায়গা দখল করে রেখেছে। এর আগে ২০১৯ এবং ২০২১ সালে এই সাহিত্যিক আন্তর্জাতিক বুকার পুরস্কারের(পূর্বের ম্যান বুকার পুরস্কার) জন্য মনোনীত হয়েছিলেন যদিও শেষ পর্যন্ত একবারও পাননি। ফ্রানজ কাফকা আর হোর্হে লুইজ বোর্হেস দ্বারা প্রভাবিত এই সাহিত্যিক বিখ্যাত কাজগুলোর মাঝে উল্লেখযোগ্য হচ্ছে 'দ্য লাস্ট লাভার', 'লাভ ইন দ্য নিউ মিলেনিয়াম'। জোয়ে'র নোবেলজয়ী হওয়ার সম্ভাবনার পরিমাণ শতকরার হিসাবে ৯ শতাংশের চাইতে কিছু বেশি। এবার দেখার পালা এই চীনা লেখিকাকে কী নোবেল কমিটি পুরস্কারের জন্য মনোনীত করে কী না।
সাহিত্যে নোবেল পাওয়ার জন্য সম্ভাব্য বিভিন্ন তালিকায় সবার উপরে হারুকি মুরাকামি আর ক্যান জোয়ে'র নামই সবচেয়ে উপরে। এদের ছাড়া আর যারা আছেন তাদের সম্ভাবনা উক্ত দুজনের তুলনায় কিছু কমই বলা চলে। এদের সম্ভাবনা শতকরা হিসাবে ৭.৭ শতাংশ।
৮৪ বছর বয়সী অস্ট্রেলিয়ান সাহিত্যিক গেরাল্ড মুরনানে এর নামও এই তালিকায় একটা ভালো অবস্থানে আছে। ১৯৮২ সালে প্রকাশিত তাঁর উপন্যাস 'দ্য প্লেইনস' এর জন্য বিখ্যাত এই লেখককে নিয়ে করা এক লেখায় নিউ ইয়র্ক টাইমস দাবি করেছিল গেরাল্ড হচ্ছেন ইংরেজি ভাষার সবচাইতে শ্রেষ্ঠ লেখক যার নাম অধিকাংশ মানুষ শোনেইনি। অস্ট্রেলিয়ার বিভিন্ন সাহিত্য পুরস্কারপ্রাপ্ত এই লেখকের ঝুড়িতে আছে বিখ্যাত প্যাট্রিক হোয়াইট পুরস্কারও। এই পুরস্কারটি অস্ট্রেলিয়ান সাহিত্যিক প্যাট্রিক হোয়াইট ১৯৭৩ সালে সাহিত্যে নোবেল পুরস্কার পাওয়ার পর থেকে চালু করেছিলেন। 'দ্য প্লেইনস' ছাড়াও এই লেখকের বিখ্যাত বইয়ের তালিকায় আছে 'লাস্ট লেটার টু এ রিডার','এ লাইফটাইম অন ক্লাউডস' সহ আরও বেশ কিছু বই। জে এম কোটজি আর প্যাট্রিক হোয়াইটের পর তৃতীয় অস্ট্রেলিয়ান হিসেবে গেরাল্ড মুরনানে কী সাহিত্যে নোবেল পাবেন তা কেবল সময়ই বলে দিতে পারে।
নরওয়েজিয়ান সাহিত্যিক জন ফসে-ও নোবেলজয়ী হওয়ার তালিকার একজন সম্ভাব্য প্রার্থী। আন্তর্জাতিক বুকার পুরস্কারের জন্য একবার মনোনীত হওয়া ৬৪ বছর বয়সী এই লেখকের বিখ্যাত রচনার মাঝে উল্লেখযোগ্য হলো 'সেপ্টোলজি','দ্য আদার নেম','ওয়েকফুলনেস' ইত্যাদি। নরওয়ে এবং বাইরের বিশ্বে অনেক সাহিত্য পুরস্কার পাওয়া এই লেখক লেখালেখি করার পাশাপাশি অনেক দিন ধরে জড়িয়ে আছেন সঙ্গীতের সাথেও। ন্যুট হামসুনের দেশের এই মানুষটি চতুর্দশ নরওয়েজিয়ান হিসাবে নোবেল লরিয়েট হবেন কী না তার জন্য অপেক্ষা করতে হবে আর মাত্র কয়েকটা দিন।
দস্তয়েভস্কি,চেখভ,তলস্তয়দের দ্বারা যে রাশিয়ান সাহিত্য বিশ্বের মাঝে অসামান্য এক জায়গা অর্জন করেছিল সেই তাদেরই পদাঙ্ক অনুসরণ করে বর্তমানে রুশদের সাহিত্যে সামনে থেকে নেতৃত্ব দিচ্ছেন ৮০ বছর বয়সী লুদমিলা উলিদস্কায়া। ছোটগল্প আর উপন্যাস লিখে জিতেছেন দেশ-বিদেশের অনেক পুরস্কার। এই লেখকও মনোনীত হয়েছিলেন আন্তর্জাতিক বুকার পুরস্কারের জন্য। যদিও শেষ পর্যন্ত সম্মানজনক এই পুরস্কার পাননি তিনি। তবে এবার যেসব সাহিত্যিক নোবেল পুরস্কার জয়ের সম্ভাবনায় এগিয়ে আছেন তাদের মাঝে রুশ এই লেখিকাও নিজের জন্য আলাদা এক জায়গা করে রেখেছেন। এই লেখিকার বিখ্যাত কিছু বই হলো 'সনেচকা','দ্য বিগ গ্রিন টেন্ট','দ্য কুকোটস্কি এনিগমা'। অনেকদিন ধরেই কোনো রাশিয়ান সাহিত্যিক নোবেল পুরস্কার পাননি। ১৯৮৭ সালে জোসেফ ব্রদস্কি নোবেল পেলেও তিনি এর প্রায় ১৫ বছর আগে থেকেই সোভিয়েত রাশিয়ার নাগরিক ছিলেন না। তাই ১৯৭০ সালে আলেকজান্ডার সলজিনিৎসেন এর নোবেলপ্রাপ্তীর পর গত পাঁচ দশক ধরে সাহিত্যে রাশিয়ানরা নোবেল না পাওয়ার তকমা জুটিয়ে বসে আছে। লুদমিলা উলিদস্কায়া কী রাশিয়ান সাহিত্যপ্রেমীদের গর্বের কারণ হতে পারবেন তা জানা যাবে অক্টোবরের প্রথম সপ্তাহেই।
সাহিত্যে নোবেল পুরস্কার পাওয়ার সম্ভাবনা যাদের আছে তাদের মাঝে একমাত্র মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের নাগরিক হলেন থমাস পিঞ্চন। ৮৬ বছর বয়সী এই লেখক তার জটিল উপন্যাসগুলোর জন্য বেশ বিখ্যাত। সাহিত্যের পাশাপাশি নন-ফিকশনেও ভালো হাত আশে থমাসের। বিজ্ঞান,সঙ্গীত,ইতিহাস ইত্যাদি বিষয়েও দুইহাতে অনেক লিখেছেন তিনি। নিউ ইয়র্কে জন্ম নেয়া এই লেখক জেমস জয়েস আর ভ্লাদিমির নভোকভের লেখা দ্বারা বেশি পরিমাণে প্রভাবিত। তার বিখ্যাত বইয়ের তালিকার আছে 'গ্র‍্যাভিটি'স রেইনবো','দ্য ক্রায়িং অব লট ৪৯' সহ আরও অনেক লেখা। থমাস যদি এবার সাহিত্যে নোবেল পান তবে আমেরিকানদের মধ্যে  টি. এস এলিয়ট,আর্নেস্ট হেমিংওয়ে,বব ডিলানদের বড় বড় নামের পাশাপাশি পনেরোতম মার্কিন হিসেবে তিনি এই পুরস্কার পাবেন। সর্বশেষ ২০২০ সালেও মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের লুইস গ্লিক সাহিত্যে নোবেল পেয়েছিলেন।

উপরে যাদের নাম উল্লেখ করা হয়েছে তাদের মাঝেই যেকোনো একজনের এবার সাহিত্যে নোবেল পুরস্কার পাওয়ার সম্ভাবনা বেশি। যিনি পাবেন তিনি হবেন সাহিত্যে নোবেল পাওয়া ১২০ তম লরিয়েট। তবে এইসব নামের পাশাপাশি অনেকেই সাম্প্রতিক সময়ে উল্লেখ করছেন ভারতীয় বংশোদ্ভূত ব্রিটিশ-মার্কিন লেখক সালমান রুশদির নামও। এইবছর তার উপরে এক আততায়ী হামলা চালিয়েছিল।যদিও রুশদি এখন মোটামুটি সুস্থই আছেন। তবে এই হামলার পর থেকেই তার নাম এবারের নোবেল পুরস্কারের জন্য অনেকের মুখে শোনা যাচ্ছে। 'মিডনাইট'স চিলড্রেন','দ্য স্যাটানিক ভার্সেস' বইয়ের জন্য বিখ্যাত এই লেখক হয়তো পেলেও পেয়ে যেতে পারেন সাহিত্যিকদের জন্য সবচাইতে সম্মানজনক এই পুরস্কার।
কিছুদিন আগেই মৃত্যুবরণ করেছেন বিশ্বখ্যাত চেক লেখক মিলান কুন্দেরা। নোবেল পুরস্কার কখনো না পাওয়া বরেণ্য এই লেখক যদি বেঁচে থাকতেন তবে এই তালিকায় তার নামও রাখা যেতো সহজেই।
আসছে অক্টোবরের পাঁচ তারিখ আমরা জেনে যাবো এবার কে পেলেন সাহিত্যে নোবেল পুরস্কার। এর আগ পর্যন্ত নিজ নিজ প্রিয় লেখকের এই পুরস্কারপ্রাপ্তির জন্য অপেক্ষা করা ছাড়া আমাদের আর কিছুই করার মতো নেই।